রাজস্ব আদায়ের গুরুত্বপুর্ণ মাস মে-জুনের শুরুতেই আন্দোলনে নেমেছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের(এনবিআর)কর্মকর্তারা । এনবিআরকে দুভাগ করে রাজস্ব নীতি এবং রাজস্ব আদায়ের জন্য দুটি আলাদা বিভাগ করে অধ্যাদেশ জারি হবার পর থেকেই তা মেনে নিতে পারেনি এসব ক্ষুদ্ধ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা । রাজস্ব আদায় পদ্ধতি সংস্কারে আপত্তি না থাকলেও জারি করা অধ্যাদেশে ডেপুটেশনে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের এনবিআরে পদায়নের সুযোগকেই বেশি আপত্তি জানায় আন্দোলনকারিরা।
এনবিআরের চেযারম্যানের পদত্যাগসহ দাবি মানা না হলেও তাদের আন্দোলন শেষ হয় অনেকটা আকস্মিকভাবেই। এখন শুরু হয়েছে ব্যবস্থা নেয়ার পালা। উঠছে নানা অভিযোগও। এরই মধ্যে বরখাস্ত হয়েছেন চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কমিশনার মো. জাকির হোসেন । এনবিআরের প্রথম সচিব আমিমুল ইহসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে তিনি একই দিনে ব্যাংক থেকে প্রায় কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এনবিআরের ১১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করছেন। তাঁদের মধ্যে এনবিআরের দুজন সদস্য আছেন। এ ছাড়া এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদারও আছেন। দুদকের মুখপাত্র আক্তারুল ইসলাম গনমাধ্যমকে বলেছেন , “অভিযুক্ত কর্মকর্তারা কর দায় কমানোর বিনিময়ে ঘুষ গ্রহণ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার কেউ কেউ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলাও দায়ের করেছেন, যারা তাদের অবৈধ দাবি পূরণে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।”
ব্যাংক থেকে একদিনেই কোটি টাকা তুলেছেন আমিমুল ইহসান
গত দুইমাস জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের(এনবিআর) আন্দোলনে যখন দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বন্দর প্রায় অচল হয়ে সরকারের রাজস্ব আদায় ব্যবস্তা পড়েছে হুমবির মুখে তখন ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো অবিযোগ তুললো হয়রানি-দুনীর্তির। এমনকি স্বয়ং দুদক যখন আন্দোলনের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে নামলো,তখনই আন্দোলন প্রত্যাহার হলো। আর এমন অবস্থায় এনবিআরের একজন মাঝারি পর্যাযের কর্মকর্তার চার মাসে কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেলো।
এনবিআরের প্রথম সচিব (প্রশাসন) আ আ মু আমিমুল ইহসান চার মাসে এক্সিম ব্যাংকের একটি হিসেবে গত বছর জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে লেনদেন করেছেন এক কোটি টাকা। বিষয়টি সন্দেহজনক তাই এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক অভিযোগও দেয়া হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে । এই রাজস্ব কর্মকর্তার দ্বারা হয়রানির শিকার ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন বড় কর্মকর্তাদের সাথে তার বিষয়েও যেন সঠিক তদন্ত হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে গত ৬ জুন আমিমুল ইহসান এক্সিম ব্যাংকের একটি হিসেবে ৪৫ রাখ টাকা জমা দিয়ে একটি মেয়াদ হিসাব খোলেন। লক্ষ্য ছিল এক কোটি টাকার একটি ফিক্সড ডিপোজিট খোলার। বিষয়টি কোনোভাবে ফাঁস হয়ে গেলে তার দপ্তরেই এ নিয়ে নানান কানাঘুষা শুরু হয় যে সততার মুখোশ পরা এই রাজস্ব কর্মকর্তা কোনো ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে ব্যাংকে রেখেছেন। বিষয়টি সহকর্মীদের কেউ কেউ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরকেও জানিয়ে দেন। তবে চেয়ারম্যানের সাথে ঘনিষ্টতা থাকায় এই প্রভাবশালী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় কোনো তদন্ত শুরু হবার আগেই তিনি প্রায় সম্পূর্ণ টাকা ব্যাংক থেকে তুলে ফেলেন। ব্যাক্তিগত আয়কর বিবরনী জমা দিলে ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, সেটাও টাকা তুলে ফেলার কারণ বলে জানা গেছে।
রাজস্ব কর্মকর্তা আমিমুল ইহসান খান ২০২৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর একই দিনে দুটি আলাদা চেকে ৯২ লাখ ২২ হাজার টাকা তুলে ফেলেন। একই দিনে একজন সরকারি কর্মকর্তার এতো বড় আকারের লেনদেন সন্দেহজনক বলে মনে করেন তার সহকর্মীরাও । নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন শুধু আর্থিক সন্দেহজনক লেনদেনই নয় প্রশাসন বিভাগে থাকার কারনে বদলি,পদায়ন নিয়ে রাজস্ব বোর্ডের অনেক সিনিয়র-জুনিয়র কর্মকতাই তার দাপটের কাছে অসহায় । রাজস্ব বিভাগের জুনিয়র কর্মকর্তাদের নিজের মর্জিমাফিক ভ্যাট কালেক্টর থেকে কাস্টমস হাউজের গুরুত্বহীন পদে পদায়ন, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় বদলি বা ঢাকা থেকে জেলায় পাঠিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে এই কর্মকর্তার স্বোচ্ছাচারিতা চরমে বলেও অভিযোগ উঠেছে। ময়মনসিংহের সিজেসি গুহ রোডের স্থায়ী বাসিন্দা আমীমুল ইহসান ঢাকায় বনশ্রী আবাসিক এলাকায় থাকেন। ২৭ তম বিসিএসের মাধ্যমে ২০০৮ সালে নিয়োগ পাওয়ার পর একাধিক শুল্ক ভবন ও ভ্যাট বিভাগে কাজ করেছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে একটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গত ২২ জুন সেগুনবাগিচার দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোতে জমা দেয়া হয়েছে। এক্সিম ব্যাংকের চেক লেনদেনের সন্দেহজনক কার্যবিবরনীর একটি কপিও এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। এনবিআরের বর্তমান অস্থিরতায় আমিমুল ইহসান খানদের কর্মকর্তাদের গোপনে কোনো তৎপরতা ছিল কি না তাও তদন্ত করে দেখা বলে মনে করে অভিজ্ঞমহল।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কমিশনার জাকির বরখাস্ত
গত ২৮ ও ২৯ জুন চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস বন্ধ রেখে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করায় জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে সাময়িক বরখাস্তের মত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি)।
গতকাল মঙ্গলবার এ–সংক্রান্ত আদেশে সই করেন আইআরডি সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান। বুধবার সকালে চট্টগ্রামের কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কমিশনার মোহাম্মদ শফি উদ্দিনকে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
রাজস্ব খাতে যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে গত ২৮ ও ২৯ জুন এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে শুল্ক-কর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালন করা হয়। এতে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসসহ সারা দেশে শুল্ক-কর কার্যালয়ে কাজ বন্ধ থাকে।
মো, জাকির হোসেনের সাময়িক বরখাস্তের আদেশে বলা হয়, দপ্তর খোলা রাখার নির্দেশনা অমান্য করে গত ২৮ ও ২৯ জুন চট্টগ্রামের কাস্টমস হাউস বন্ধ রেখে আমদানি রপ্তানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি করায় মো. জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক বিভাগীয় কার্যধারা অনুসারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। সাময়িক বরখাস্তকালে তিনি বিধি অনুসারে খোরপোষ ভাতা প্রাপ্য হবেন।
এর আগে ২৯ জুন দুদক এনবিআরের আরও ছয়জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। যাদের বিরুদ্ধে কর্তৃত্বের অপব্যবহার ও গত দুই দশক ধরে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অবৈধ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এমন সব অভিযোগে যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে তারা হলেন- বৃহৎ করদাতা বিভাগের (ভ্যাট) অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল রশিদ মিয়া, সদস্য মো. লুৎফুর আজিম, কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের (সিআইআইডি) সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. আলমগীর হোসেন, ঢাকার কর অঞ্চল-১৬ এর উপ-কর কমিশনার মো. শিহাবুল ইসলাম এবং যুগ্ম কমিশনার মো. তারেক হাসান।
এই ছয় কর্মকর্তার মধ্যে হাসান তারেক এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি হিসেবে পরিচিত। তার নেতৃত্বাধীন পরিষদটি রাজস্ব বোর্ড ভেঙে দেওয়ার পরিবর্তে এর অভ্যন্তরে কাঠামোগত সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছে।