প্রবাসী ভোট: প্রক্সি পদ্ধতি নিয়ে নিয়ে সন্দেহ দলগুলোর

4

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটের সুযোগ দিতে চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তিনটি ভোটপদ্ধতির (পোস্টাল, অনলাইন ও প্রক্সি) মধ্যে ইসির ঝোঁক প্রক্সি পদ্ধতির দিকে থাকলেও, এর নিরাপত্তা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
এ বিষয়ে মত দিতে ১৫ মের মধ্যে দলগুলোকে লিখিত মতামত দিতে বলেছে ইসি।
মঙ্গলবার আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে আয়োজিত ‘প্রবাসীদের ভোটিং সিস্টেম উন্নয়ন’ বিষয়ক সেমিনারে এসব আলোচনা উঠে আসে। এতে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ অন্তত ২১টি দলের প্রতিনিধি অংশ নেন।
সেমিনারের উদ্ধোধনী বক্তব্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার পদ্ধতি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলসহ সব অংশীজনের সমর্থন প্রয়োজন। তিনি বলে, রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন না পেলে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সব উদ্যোগ বিফলে যাবে।
তিনি বলেন, “আমরা পরবর্তী নির্বাচনে অন্তত শুরু করতে চাই। যাত্রা শুরু হোক। অনেক দেশ চালু করেছে, অনেক দেশ চালু করতে পারেনি। আমরা সীমিত পরিসরে চালু করতে চাই। এ জন্য আপনাদের (রাজনৈতিক দল) সমর্থন চাই। আশা করি, সমর্থন পাব।’
নাসির উদ্দিন বলেন, “আমরা এটা নিয়ে কাজ করেছি। দেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতা ও শিক্ষা সব কিছু পর্যালোচনা করে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব। রাজনৈতিক নেতারা সমর্থন না দিলে কোনো কিছুই বাস্তবায়ন হবে না। মানুষের আস্থা যেন থাকে, কম খরচে যেন বাস্তবায়ন করতে পারি সেই পদ্ধতি বেছে নিতে হবে।”
এছাড়া নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, “আমরা উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট চাই। এই উৎসবে প্রবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করতে চাই। তবে রাজনৈতিক দলের সমর্থন না পেলে কোনো চেষ্টায় সফল হবে না।”
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে পোস্টাল ব্যালট, অনলাইন ভোটিং ও প্রক্সি ভোটিংয়ের যেকোনো একটি পদ্ধতি চালু করতে চাচ্ছে ইসি। সামনের নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে বলে প্রধান উপদেষ্টা ও বর্তমান ইসির তরফে গত কয়েক মাস ধরেই বলা হচ্ছে।
নাসির উদ্দিন কমিশন প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোট পদ্ধতি নিয়ে গত ৮ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, এমআইএসটি, সমাজক্যাণ মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি কর্মশালা আয়োজন করে। সেখানে অনলাইন ভোট, প্রক্সি ভোট ও পোস্টাল ব্যালট পদ্ধতি উপস্থাপন করা হয়। এমআইএসটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট তিনটি পদ্ধতি নিয়ে তিনটি প্রতিবেদন দিয়েছে কমিশনে।
এর মধ্যে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিবিদদের নিয়ে ‘অ্যাডভাইজরি টিম’ গঠন করেছে ইসি সচিবালয়। গত বৃহস্পতিবার ওই টিমের প্রথম সভার পর অংশীজনের নিয়ে এবার সেমিনার হলো।
বিএনপির প্রবাসীদের ভোটে সম্মতি, পদ্ধতি নির্ধারণে দলীয় ফোরামে আলোচনা
সেমিনারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, “প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে কেবল এনআইডি নয়, পাসপোর্টকেও বিবেচনায় নিতে হবে। কেননা, অনেক প্রবাসীর এনআইডি নেই।”
তিনি বলেন, “২০১৪ সালে আরপিও সংশোধনের সময়, ২০১৭ সালের ‘ভিশন ২০–৩০’, ২০২২ সালের ২৭ দফা ও ২০২৩ সালের ৩১ দফার রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাবেও আমরা প্রবাসীদের ভোটাধিকারের কথা বলেছি। আমরা প্রবাসীদের ভোটাধিকার বাস্তবায়নের পক্ষে। তবে কোন পদ্ধতি সবচেয়ে সহজ, গ্রহণযোগ্য ও সাশ্রয়ী—তা দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানাব।”
প্রক্সির দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন জামায়তের
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য জসিম উদ্দিন সরকার বলেন, “উদ্যোগ নিলেই অর্ধেক কাজ হয়ে যায়। এটি ভালো উদ্যোগ। ট্রায়াল অ্যান্ড এররের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।”
জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, “ইসির প্রতি আস্থা কমেছে। প্রক্সি পদ্ধতিতে প্রকৃত ভোটারের মতামত প্রতিফলিত নাও হতে পারে।”
এনসিপি: প্রক্সি পদ্ধতিতে আস্থার ঘাটতির আশঙ্কা
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ বলেন, “প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে পূর্ণ প্রচেষ্টা দরকার। প্রক্সি পদ্ধতিতে ভোটের হার বাড়লেও এটি একটি সম্ভাব্য হুমকি।” তিনি বলেন, “ভোটের ক্ষেত্রে ‘ট্রাস্ট’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রক্সি নিয়ে সন্দেহ থাকায় দলীয় ফোরামে আলোচনা করে মতামত জানাবো।”
ডায়াস্পোরা অ্যালায়েন্সের সদস্য এহতেশামুল হক বলেন, “ইসির ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রবাসীদের আচরণবিধি মানার বিষয়েও ইসিকে কঠোর হতে হবে।”
গণঅধিকার পরিষদ: নিরাপত্তা ও গ্রহণযোগ্যতার ওপর জোর
দলটির সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, “দুই কোটি প্রবাসী ভোটার রয়েছেন। তাদের জন্য যে পদ্ধতি সহজ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, সেটিই বেছে নিতে হবে।”
তিনি বলেন, “প্রক্সি ভোটে নিরাপত্তা একটি বড় প্রশ্ন। মা-বাবা দুইজন দুই দলকে সমর্থন করলেও প্রক্সি ভোটে কাকে ভোট যাবে?”
এবি পার্টি: পাসপোর্টকেও বিবেচনায় নিতে হবে
এবি পার্টির শ্যাডো অ্যাফেয়ার্স সেক্রেটারি আব্বাস ইসলাম খান বলেন, “পশ্চিমা দেশে অনেকের এনআইডি নেই, শুধু পাসপোর্ট আছে। তাই পাসপোর্টকেও আইডি হিসেবে গ্রহণযোগ্য করতে হবে।” তিনি বলেন, “অনলাইন পদ্ধতিতে নিরাপত্তা না থাকলে আস্থা আসবে না। প্রক্সি পদ্ধতি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ঝুঁকিপূর্ণ।”
সিপিবি: আরও আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত
সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন বলেন, “তিনটি পদ্ধতিরই সুবিধা–অসুবিধা রয়েছে। দলগুলোর আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।”
প্রবাসী দেড় কোটি ভোটারের গুরুত্ব উল্লেখ করে তিনি আরও সতর্ক আলোচনা চেয়েছেন।
অন্যান্য দলগুলোর মতামত
নাগরিক ঐক্যের সাকিব আনোয়ার বলেন, “তাড়াহুড়ো করে যেন ভুল না হয়। আস্থা ফিরিয়ে আনা গুরুত্বপূর্ণ।”
বাংলাদেশ লেবার পার্টির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ইরান জানান, “তাদের দল প্রক্সি ভোটের পক্ষে, তবে অনলাইন ও পোস্টাল ভোটে আগ্রহ নেই।”
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ কংগ্রেস, সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট, বাংলাদেশ জাসদ ও বাংলাদেশ মুসলিম লীগ দলীয় ফোরামে আলোচনা করে মত জানাবে।
বাংলাদেশ কংগ্রেস প্রক্সি ভোটে জালিয়াতির আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ মুসলিম লীগের সভাপতি কাজী আবুল খায়ের বলেন, “ভোট পদ্ধতি নিয়ে একমত না হলে ভুল হলেও সবাইকে মেনে নিতে হবে।”

- Advertisement -

- Advertisement -

You might also like