যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বাণিজ্য ঘাটতিকে ‘জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি’ আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের সব ধরনের রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে এক চিঠি দিয়েছেন তিনি। আগামী ১ আগস্ট থেকে এই শুল্ক কার্যকর হবে বলে জানানো হয়েছে।
চিঠিতে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ যদি এর জবাবে নিজেদের শুল্ক বৃদ্ধি করে, তবে সেই বর্ধিত হারও যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত ৩৫ শতাংশের সঙ্গে যুক্ত হবে।
মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় ভোর ২টা ৩৬ মিনিটে ট্রাম্প ওই চিঠি প্রকাশ করেন। এতে তিনি বলেন, “আগামী ১ আগস্ট, ২০২৫ থেকে, আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো যেকোনো এবং সকল বাংলাদেশি পণ্যের উপর খাতভিত্তিক সকল শুল্কের বাইরে আলাদাভাবে মাত্র ৩৫% শুল্ক আরোপ করব।”
চিঠিতে বলা হয়েছে, অন্য কোনো দেশ হয়ে পণ্য পাঠালেও তা একই হারে শুল্কের আওতায় পড়বে।
ট্রাম্প লিখেছেন, “আপনার দেশের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতির বৈষম্য দূর করার জন্য যা প্রয়োজন, এই ৩৫ শতাংশ সংখ্যাটি তার চেয়ে অনেক কম।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ যদি পাল্টা শুল্ক আরোপ করে, তাহলে সেই অতিরিক্ত হার যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫ শতাংশের সঙ্গে যোগ হবে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রে কারখানা স্থাপন করে পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে শুল্ক আরোপ হবে না বলে আশ্বাস দিয়েছেন ট্রাম্প।
চিঠিতে ট্রাম্প বলেন, “এই ঘাটতি আমাদের অর্থনীতির জন্য এবং প্রকৃতপক্ষে, আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি বড় হুমকি!”
এদিকে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দল বাণিজ্য আলোচনা চালিয়ে যেতে এখনো ওয়াশিংটনে অবস্থান করছে। সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমানও সাথে আছেন।
তবে ট্রাম্পের ঘোষণাই আপাতত চূড়ান্ত বলে মনে করা হলেও আলোচনার একটি রাস্তাও চিঠিতে খোলা রাখা হয়েছে।
ট্রাম্প লিখেছেন, “আপনি যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আপনার এযাবৎকাল ধরে বন্ধ থাকা বাণিজ্যিক বাজারগুলো খুলে দিতে এবং আপনার শুল্ক ও অশুল্ক নীতি এবং বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে ইচ্ছুক হন, তাহলে আমরা হয়তো এই চিঠির বিষয়ে একটি সমন্বয়ের কথা বিবেচনা করব।”
মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে এক ফেসবুক পোস্টে প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একাধিক দফা আলোচনা হয়েছে, আরও একটি বৈঠক হবে ৯ জুলাই।
তিনি বলেন, “আমরা আশা করছি এই আলোচনার মাধ্যমে উভয় দেশের জন্য লাভজনক একটি শুল্ক চুক্তিতে পৌঁছানো সম্ভব হবে।”
চিঠির বিষয়ে বাংলাদেশ সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত হয়েছে বলে জানানো হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক আরোপের ঘোষণা আসে তিন মাস ধরে চলা আলোচনার পর। এপ্রিল মাসে ট্রাম্প বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার আগে গড়ে শুল্কহার ছিল ১৫ শতাংশ।
এই প্রেক্ষাপটে ৭ এপ্রিল ট্রাম্পকে চিঠি দেন প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস। চিঠিতে তিনি বলেন, “চলমান পরিকল্পিত কাজগুলো আমরা পরবর্তী প্রান্তিকের মধ্যে শেষ করব। মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সূচারুভাবে শেষ করতে দয়া করে প্রয়োজনীয় সময় আমাদের দিন।”
তিনি আশ্বাস দেন, “যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে যা যা করা দরকার বাংলাদেশ তা করবে।”
চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য আমদানি, শুল্ক ও অশুল্ক বাধা অপসারণ, এবং মার্কিন পণ্যের জন্য বাজার সহজ করার নানা উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন ইউনূস।
তিনি বলেন, “আমাদের পদক্ষেপের একটি মূল লক্ষ্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য বিশেষ করে তুলা, গম, ভুট্টা ও সয়াবিন আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা… ডিউটি-ফ্রি সুবিধাসহ নির্ধারিত ‘বন্ডেড ওয়্যারহাউজিং’ সুবিধা চূড়ান্ত করছি।”
বাংলাদেশে স্টারলিংক চালুর উদ্যোগকেও এই বাণিজ্য সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে তুলে ধরা হয় চিঠিতে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমি এই চিঠির মাধ্যমে আপনাকে আশ্বস্ত করতে চাই যে, আপনার বাণিজ্যিক এজেন্ডা পূর্ণ সমর্থনে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ বাংলাদেশ গ্রহণ করবে।”
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভিয়েতনামের নতুন বাণিজ্য চুক্তি বাংলাদেশের জন্য বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানির দিক থেকে বাংলাদেশের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম। চুক্তি অনুযায়ী, সেখানে শুল্কহার হবে ২০ শতাংশ, যা বাংলাদেশের নতুন ৩৫ শতাংশের তুলনায় অনেক কম।
প্রতিদ্বন্দ্বিতার এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত বড় ধাক্কার মুখে পড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে, ট্রাম্পের ঘোষণাটি একতরফা সিদ্ধান্ত বলেও উল্লেখ করেছে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এপি। তাদের ভাষায়, “এই চিঠিগুলো কোনো দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার ফল নয়… রুদ্ধদ্বার আলোচনার ফলাফল কোনো পক্ষের জন্যই সন্তোষজনক হয়নি।”
এবার ঘোষিত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ছাড়াও মিয়ানমার ও লাওসের পণ্যের ওপর ৪০ শতাংশ, কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের ওপর ৩৬ শতাংশ, সার্বিয়া ৩৫, ইন্দোনেশিয়া ৩২, দক্ষিণ আফ্রিকা ও বসনিয়া ৩০ এবং জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, কাজাখস্তান, মালয়েশিয়া ও তিউনিসিয়ার ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও দেশ এই তালিকায় আসতে পারে বলে ধারণা।