ভোটে অনিয়ম হলে পুরো আসনের নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা ফেরত পেতে আইন সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কারের পথে এগোনের পদক্ষেপের মধ্যে এই উদ্যোগ নিয়েছে সাংবিধানিক সংস্থাটি।
বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সাংবাকিদের বলেন, “কোন নির্দিষ্ট আসনের নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য আমরা আবেদন করেছি। পুরো আসনের নির্বাচন বন্ধের ক্ষমতা আমাদের আগে ছিল। সেটা বাদ দেওয়া হয়েছিল। এখন আমাদের কেন্দ্রের ভোট বাতিলের ক্ষমতা আছে।”
২০২৩ সালের ১৯ মে আওয়ামী লীগ সরকার ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ’ (আরপিও) সংশোধনের খসড়া অনুমোদন দেয়, যেখানে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পুরো আসনের ভোট বাতিলের ক্ষমতা বাদ দেওয়া হয়। তবে বর্তমানে সরকার আইনটি আবার সংশোধন করতে চায়। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে পুনরায় পুরো আসনের ভোট বাতিলের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখতে প্রধান উপদেষ্টা নির্দেশ দিয়েছেন। বুধবার রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার।
ইসি সানাউল্লাহ বলেন, “কেন্দ্র বাতিলের সক্ষমতা ইসির ছিল; যেটা ছিল না সেটা হচ্ছে পুরা নির্বাচনী আসনের বন্ধ করার। যেটা একসময় সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এটাও আমরা ফেরত পাওয়ার জন্য আমরা প্রস্তাব করেছি এবং আশা করি আমরা এটা ফেরত পাব।”
আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত অষ্টম কমিশন সভা শেষে সাংবাদিকদের সভা সম্পর্কে জানান কমিশনার সানাউল্লাহ। ছয় ঘন্টাব্যাপী বৈঠকে আরপিও (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫; নির্বাচন কমিশন সচিবালয় (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫; নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫; মনোনয়নপত্রে প্রার্থীর হলফনামা সংশ্লিষ্ট বিষয়; ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা এবং আরও কয়েকটি বিবিধ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়।
প্রবাসী ভোটে পোস্টাল ব্যালট, ইভিএম একেবারে বাদ
প্রবাসী ভোটারদের জন্য এবার প্রথমবারের মতো আইটি সাপোর্টেড পোস্টাল ব্যালট চালু করা হচ্ছে জানিয়ে সানাউল্লাহ বলেন, “চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হচ্ছে প্রবাসী বাংলাদেশিরা এবারে ভোট দেবে। ভোট পদ্ধতি হবে পোস্টাল ব্যালট, সীমাবদ্ধতা কাটাতে আইটি সাপোর্টেড পোস্টাল ব্যালট আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রবাসীরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে অনলাইন আবেদন করবে। সময় বাঁচাতে এবার ব্যালট পেপার বিশেষ ব্যবস্থায় ব্যালট প্রিন্ট হওয়ার পর ভোটারের কাছে পাঠানো হবে।”
প্রবাসীদের ভোটিাধিকারের বিষয়ে এ নির্বাচন কমিশনার জানান, অনলাইন নিবন্ধনের জন্য একটি প্রকল্প নেওয়া হবে। সেই সঙ্গে অনলাইনে নিবন্ধন করলে ইসি সরাসরি পোস্টাল ব্যালট সংশ্লিষ্ট ভোটারের কাছে পাঠাবে। ভোটদান শেষে তা সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকয় রিটার্নিং অফিসারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।
পোস্টাল ভোট কীভাবে হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এখন আমরা যেটা ডেভেলপ করছি সেটা হচ্ছে অনলাইন রেজিস্ট্রেশন প্লাটফর্ম। এই রেজিস্ট্রেশন কিন্তু দুই ধরনের। একটা হচ্ছে ভোটার রেজিস্ট্রেশন একজনকে তো ভোটার হতে হবে এস পার দ্য আইন টু ভোট, সেটা হচ্ছে ভোটার রেজিস্ট্রেশন। আরেকটা হচ্ছে ওসিভি রেজিস্ট্রেশন, বিদেশ থেকে ভোট দেওয়ার জন্য রেজিস্ট্রেশন। যেটা আগে আবেদন করে নিতে হতো এটা অনলাইনে বসে করতে পারবেন এই হচ্ছে পার্থক্য।”
অনলাইন ভোটিং প্রসঙ্গে ইসি বলেন, “অনলাইন ভোটিং এর ব্যাপারটাকে এগিয়ে নেওয়া হবে। এটা ট্রায়াল পর্যায়ে হয়তো পৌঁছতে পারব। বাট এটা ভোটিং পর্যায়ে পৌঁছাতে পারব না।”
অন্যদিকে ইভিএমের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি-ইভিএম সামনে কোনো নির্বাচনে ব্যবহার হবে না। ঐক্যমত ও সংস্কার কমিশনের সুপারিশেও ইভিএমের পক্ষে মত নেই।’”
পড়ে থাকা ইভিএম নিয়ে কী করা হবে জানতে চাইলে এই কমিশনার বলেন, “এমতাবস্থায় এই ইভিএম কীভাবে কী করতে হবে সেটার জন্য একটা কমিটি ফর্ম করতে বলা হয়েছে।”
হলফনামায় আজীবন ফৌজদারি বিবরণ বাধ্যতামূলক
মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দেওয়া প্রার্থীর হলফনামায় ফৌজদারি মামলার ২০ বছরের সীমা তুলে দিয়ে আজীবনের তথ্য সংযুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। কমিশনার সানাউল্লাহ বলেন, “গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন ও নির্বাচন কর্মকর্তা বিশেষ আইন ১৯৯১-এর সংশোধনী নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় সভায়। প্রার্থীদের হলফনামায় দ্বৈত নাগরিকত্ব ও ফৌজদারি মামলার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে— এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ফৌজদারি মামলার তথ্য লাইফটাইম হিস্ট্রি হিসেবে সংরক্ষণ করা হবে।”
তিনি বলেন, “সংশোধিত হলফনামাটাকে বেশ টাইট করা হয়েছে এবং এটা সংস্কার কমিশনের যতগুলো প্রস্তাব ছিল মোটামুটি সবগুলো এখানে ধারণ করা হয়েছে।”
সংসদীয় আসন পুর্নবিন্যাস: ঢাকায় পরিবর্তন কম
সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাস প্রসঙ্গে সানাউল্লাহ বলেন, “ডিলিমিটেশনটা আমাদের ফাইনাল পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। টেকনিক্যাল কমিটি দ্বারা এটাকে স্ক্রুটিনি করার সুযোগ আছে। আগামী সপ্তাহে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। তবে ঢাকায় আসন সংখ্যা খুব বেশি কমবে না।”
এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, “খসড়া প্রকাশের উদ্যোগ নিচ্ছে ইসি। কারিগরি কমিটির প্রতিবেদন পেলে শিগগির খসড়া প্রকাশ করা হবে। সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ২২১ টা আসনের বিষয়ে কোনো আবেদনই হয়নি। আশা করি, আগামী সপ্তাহে পুরো প্রকাশ হবে।”
খসড়া ভোটার তালিকা
বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম প্রসঙ্গে সানাউল্লাহ বলেন, “আজ পর্যন্ত ৪৪ লাখ ৬ হাজার ৬০২ জন বাদ পড়া ভোটার আমরা পেয়েছি যারা নিবন্ধন করেছেন নতুনভাবে। আর তালিকার মধ্যে মৃত ভোটার পেয়েছি ২১ লাখ ৩২ হাজার ৫৯০ জন।”
তিনি জানান, ভোটার তালিকা হালনাগাদের একটি সম্পূরক তালিকা আগামী সপ্তাহেই প্রকাশ করা হবে।
নতুন দল নিবন্ধন
নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধনের প্রাথমিক যাচাইয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে জানিয়ে কমিশনার সানাউল্লাহ বলেন, “যাচাইয়ের পরে যে সব দল ফরমেট অনুযায়ী সব শর্ত সম্পন্ন করেছেন সেগুলো মাঠ পর্যায়ে ভেরিফিকেশনের জন্য চলে যাবে। আর যারা সম্পন্ন করেননি তাদের ১৫ দিনের সময় দিয়ে আবারও চিঠি দেয়া হবে।”
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ
সানাউল্লাহ জানান, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধনের বিষয়টি আজকের সভায় উপস্থাপন হয়েছে। পরে এটি নিয়ে আলোচনা হবে। কমিশন সভায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন বা অধ্যাদেশ নিয়ে আলোচনা হয়েছে সচিব এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের নিয়োগের জন্য নির্বাচন কমিশন সার্ভিস নামে একটা সার্ভিস যেটা সংস্কার প্রস্তাব করেছেন। আমরা এটার সাথে একমত শুরু থেকেই এবং এটা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান দ্বারা পরিচালিত হবে।
তিনি জানান, নির্বাচন কর্মকর্তা বিশেষ আইন ১৯৯১ এর যেটা সংশোধনী, এখানেও ছোট তিন থেকে চারটি পরিবর্তন আনা হয়েছে।
সানাউল্লাহ বলেন, “নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের প্রশাসনিক এবং আর্থিক ক্ষমতা পুনঃঅর্পণ এটা রিভাইজ করা হয়েছে। কিছু জিনিস ফাইন টিউন করা হয়েছে। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে উপরে যারা নিয়োগ পাবেন তাদের নিয়োগটা কমিশন কর্তৃক অ্যাপ্রুভড হবে। আগে যেটা সরাসরি সচিব করতেন।”
তিনি বলেন, “নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে যে ডিপার্টমেন্টাল হেড, তার নিয়োগও কমিশন করবে। পাশাপাশি টেকনিক্যাল যে বা যারা আছেন তাদের ব্যাপারে আমরা একটা নীতিমালা করতে যাচ্ছি।”