অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে জনগণের প্রত্যাশা ও কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের প্রতিফলন নেই বলে অর্থনীতির গবেষণা সংস্থা সিপিডির মূল্যায়নে বলা হয়েছে।
বাস্তবভিত্তিক প্রবৃদ্ধি পরিকল্পনা নেই বলে মত দিয়ে এও বলা হয়েছে, বাজেট বাস্তবায়ন অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
মঙ্গলবার রাজধানীর গুলশানে লেকশোর হোটেলে প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে আয়োজিত প্রতিক্রিয়া সভায় প্রশ্নোত্তর পর্বে এমন মন্তব্য করেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, “বাজেটের পূর্বে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর সংস্কারের কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। ফলে কর আহরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এবং এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
“বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের সুপারিশও বাজেটে প্রতিফলিত হয়নি।”
সোমবার অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ আগামী অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন, তার সমালোচনা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকেই।
দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাজেট কমিয়েছেন তিনি। উন্নয়ন বাজেট ছেঁটে ফেলেছেন আগের বছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় ১৩ দশমিক ২ শতাংশ।
প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারকদের সমিতি বিজিএমইএ ছাড়া ইতিবাচক বক্তব্য এসেছে কমই। বিএনপি, জামায়াত এমনকি এনসিপির মতো দলগুলোও কড়া সমালোচনা করছে।
অর্থনীতির গবেষকরাও বাজেটের সমালোচনা করছে। তারা বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতাচ্যুত সরকারের কাঠামো অনুসারেই বাজেট করেছে। এখানে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের কোনো দিক নির্দেশনা নেই বলেও সমালোচনা উঠেছে।
অর্থ উপদেষ্টা বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে নিজেই বলেছেন, “অনেকে বলেছেন আমরা আগের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছি। আসলে আমরা এসব অনুসরণ না করে চট করে বিপ্লবী একটা বাজেট দিয়ে দেব, দারুণ একটা রেভিনিউ আনব সেটা সম্ভব নয়।
“আমরা কতগুলো ফ্রেমওয়ার্ক বা পদাঙ্ক অনুসরণ করে সামনে যাচ্ছি ঠিক। এবার যে ইনোভেশন নেই সেটা কিন্তু নয়। কিছু পদক্ষেপও আছে। বাজেট তিন বছর হওয়ায় বাজেট চলমান থাকায় ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।”
বাজেটের নানা সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ নিজেই বলেছেন চট করে বিপ্লবী বাজেট দেওয়া সহজ কাজ নয়।
সিপিডির মূল্যায়ন তুলে ধরে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে সামান্য বাড়িয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করা হয়েছে, যা ২০২৬-২৭ অর্থবছর থেকে প্রযোজ্য হবে। তবে মূল্যস্ফীতির বিচারে এই সীমা বাড়ানো অপ্রতুল।”
করমুক্ত আয়সীমায় কিছুটা ছাড় দিয়েও আয়ের প্রতিটি স্তরেই অতিরিক্ত কর আরোপের যে প্রস্তাব করা হয়েছে, সে প্রসঙ্গেও কথা বলেন সিপিডির ফেলো।
তিনি বলেন, উচ্চ আয়ের মানুষের জন্য সর্বোচ্চ করহার ৩০ শতাংশ নির্ধারণ করাকে ইতিবাচক মনে করলেও, মধ্যম আয়ের (৬ থেকে ১০ লাখ টাকা বার্ষিক আয়) কর হার বৃদ্ধিকে সমর্থনযোগ্য নয়।
টার্নওভার ট্যাক্স ও আমদানি শুল্ক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনকে সামনে রেখে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপে রপ্তানিমুখী শিল্পের প্রতিরক্ষণ কিছুটা হ্রাস পেলেও, আমদানি প্রতিস্থাপক শিল্পের জন্য তা চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।
“প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আমরা বাজেটে দেখিনি।”
কর্মসংস্থান প্রসঙ্গে মোস্তাফিজুর বলেন, “জুলাই-আগস্টে আন্দোলনের সময় কর্মসংস্থানে বৈষম্য হ্রাসের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু বাজেটে বেকার জনগোষ্ঠী ও প্রশিক্ষণ বঞ্চিতদের জন্য কোনো সুস্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়নি।”
বিনিয়োগে সংরক্ষণ কমানোর ফলে আমদানি প্রতিস্থাপন শিল্প চাপে পড়তে পারে বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
‘প্রবৃদ্ধি বাস্তবসম্মত নয়’
অর্থ উপদেষ্টা আগামী অর্থবছরের জন্য দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ রাখার যে লক্ষ্য ঠিক করেছেন, সেটি বাস্তবসম্মত নয় বলেও মনে করেন সিপিডির ফেলো।
তিনি বলেন, “চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে প্রায় ৪ শতাংশ হলেও বাজেটে তা ৫ শতাংশ ধরে নেওয়া হয়েছে, যা বাস্তবভিত্তিক নয়।”
রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নিয়েও সংশয়
অর্থ উপদেষ্টা যে বাজেট দিয়েছেন, তাতে তিনি ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ে পরিকল্পনা করেছেন। এই অঙ্ক চলতি অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ৩৬ হাজার কোটি টাকা বেশি।
অর্থবছরের ১০ মাসে সরকার সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও যেখানে ৭১ হাজার কোটি টাকা পিছিয়ে, সেখানে আগামী অর্থবছরে এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব কীভাবে আসবে, তা নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা অর্থ উপদেষ্টা দেননি।
সিপিডির ফেলো মোস্তাফিজুরও বলেন, “(চলতি অর্থবছরে) প্রকৃত রাজস্ব আহরণ পূর্বাভাসের তুলনায় ৭০-৮০ হাজার কোটি টাকা কম হতে পারে। এই ঘাটতি পুষিয়ে নিতে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ১৭-১৮ শতাংশ করতে হবে, যা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।”
বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরতা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। তার মতে, “৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় এবং ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি আয় ধরে মাত্র ৪ হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত দেখানো হয়েছে, অথচ ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা উন্নয়ন ব্যয়ের বড় অংশই ঋণের ওপর নির্ভরশীল।”
সিপিডি ফেলো বলেন, বাজেট কাঠামোর বাইরে প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কার, স্বচ্ছ অর্থনৈতিক কৌশল ও বাস্তবভিত্তিক প্রবৃদ্ধি পরিকল্পনা ছাড়া ঘোষিত বাজেট বাস্তবায়ন অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
You might also like

সম্পাদক :মোঃ শাহজালাল
২০২৫ © ব্যানারনিউজবিডি কর্তৃক সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
🚧 এই সাইটটি বর্তমানে নির্মাণাধীন 🚧
২০২৫ © ব্যানারনিউজবিডি কর্তৃক সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
🚧 এই সাইটটি বর্তমানে নির্মাণাধীন 🚧
You cannot print contents of this website.