নিকেতনে গেলে এক নীরব হাহাকার শোনা যায়
প্রোডাকশন হাউসের কাজ কমে যাওয়ায় শিল্পী,কলা-কুশলীদের দুর্দশা নিয়ে ফেসবুকে লিছেন আনন্দ কুটুম
নিকেতনে গেলে এক নীরব হাহাকার শোনা যায়। কাজ নাই। সবাই কস্ট কাটিং মুডে আছে। কেউ অফিস ভাড়া দিতে পারছে না। কেউ ক্রু পেমেন্ট দিতে পারছে না। কেউ কর্মী ছাটাই করতেছে। মিডিয়ার অভ্যন্তরীণ অবস্থা খারাপ। এর মধ্যে শুধুমাত্র সরকারের এজেন্ডা ভিত্তিক কিছু কাজ হচ্ছে। অধিকাংশই বেচে আছে এই কাজগুলোর উপরে। গত দুইদিন ৫-৭ টা হাউজে ঘুরেছি। সব হাউজেই সরকারি কাজ চলছে। সরকারের এজেন্ডা, প্রোপাগান্ডা, ন্যারেটিভ তৈরি করেই এখন মিডিয়ার মানুষ মোটামুটি খেয়ে পরে বেচে আছে।
লীগের আমলেও প্রচুর প্রোপাগান্ডা ওয়ার্ক হয়েছে। দিবসে দিবসে লক্ষ-কোটি টাকার ইভেন্ট, অডিও-ভিজুয়াল তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি প্রচুর কর্পোরেট কাজও হয়েছে তখন। প্রচুর ইন্ডিপেন্ডেন্ট কাজও হয়েছে। যদিও মিডিয়া পাড়ায় অভাব সব সময়ই ছিলো। কিন্তু মোটামুটি সবাই পেটে ভাতে খেয়ে এক রকম ছিলো। কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আগে যারা ইউটিউব মার্কেটের উপর নির্ভর করে বিনিয়োগ করেছিলো তারাও বিনিয়োগ হারিয়ে প্রায় তলানিতে আসার অবস্থা। আগের মতো মনিটাইজেশন পাচ্ছে না। ফলে কনটেন্টের পরিমাণ দিন দিন কমে আসছে, অফিস ছোট হচ্ছে, স্ট্যাফ কাটিং হচ্ছে। তাদেরও ব্যবসা কমে আসছে।
মিডিয়ার অভ্যন্তরে এক নীরব হাহাকার। সেদিন তো এক অভিনেত্রী বলেই ফেললেন গত এগারো মাস তার কোন কাজ নেই। কিন্তু যারা বলতে পারে না তাদের অবস্থা আরও ভয়াবহ।
আওয়ামিলীগ পন্থী অভিনয়শিল্পী, নির্মাতাদের কেউ কাজ দিচ্ছে না। জামাত-বিএনপি পন্থী নির্মাতা শিল্পীরা এবং আওয়ামিলীগ পন্থী যারা ভোল পাল্টে এই সরকারের সাথে জুটে যেতে পেরেছে তারা কিছু কাজবাজ পাচ্ছে সরকার থেকে। কিন্তু তাও অপ্রতুল। এর মধ্যে অধিকাংশ কাজই যাচ্ছে মোস্তফা সারওয়ার ফারুকীর ভাই ব্রাদারের হাতে। বড় ভাই যখন উপদেষ্টা, ছোট ভাইদের তো তখন কিছু হক থাকে। সব আমলেই এই প্র্যাক্টিস্টটা ছিলোই। বদলায়নি কিছুই।
ডিরেক্টর, প্রডিউসার থেকে টেকনিশিয়ানদের অবস্থা তুলনামূলক ভালো। কারন ঘুরে ফিরে তারা সবার কাজে অল্প বিস্তর যুক্ত হতে পারছে। যদিও রেজিম চেঞ্জের ফলে অনেকের অনেক পেমেন্ট আটকে গেছে। জীবনে তা আর কখনো উদ্ধার হবে কি না কেউ জানে না। ক্লায়েন্ট পালাতক। পেমেন্ট দেবে কে?
নাটকের ইন্ডাস্ট্রি প্রায় বন্ধ হবার অবস্থায় আছে। কর্পোরেট গুলো আগের মতো বিজ্ঞাপন বানাচ্ছে না। ইউটিউব ভিত্তিক ব্যবসায় মন্দা। এনজিও ভিত্তিক ডকুমেন্টারিও আগের মতো হচ্ছে না। সব সেগমেন্টে মন্দা। সরকারের প্রোপাগান্ডা ওয়ার্কই শেষ ভরসা বেচে থাকার জন্য এখন।
গতকাল শুনলাম উত্তরাতে শুটিং হাউজ বন্ধের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। একেবারে ধুকে ধুকে চলা একটা ইন্ডাস্ট্রির কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হবে শুটিং হাউজ বন্ধ করে দেওয়া।
সরকারি চলচ্চিত্র অনুদান নিয়ে এবছর অনেক কাদাজল ঘোলা হয়েছে। ফলে সরকার অনুদানের টাকা সাময়িক ভাবে আটকে দিয়েছে। সরকার গড়ে ২০ কোটি টাকা অনুদান দেয় এক বছরে। এই ২০ কোটি টাকায় বড়জোর ২০০ মানুষের এক বছরের খরচা চলতে পারে। তাও অনির্দিষ্টকালের জন্য সেই টাকাটাও আটকে গেছে। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিতে ফুল টাইম- পার টাইম মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজারের উপরে মানুষ কাজ করে।
বড় বড় শিল্পী যারা আগে অভিনয় না করলেও দোকানের ফিতা কেটে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের গেস্ট এপিয়ারেন্স হয়ে, ক্লাব পার্টিতে ঘুরে ফিরে কোনমতে খেয়ে পরে বেচে ছিলো। তাদের অবস্থাও খারাপ। আগের মতো কাজ আসছে না। তারা ফিতা কাটতে গেলেই তাদের বিরুদ্ধে মব সৃষ্টি হচ্ছে বলে স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি মিলছে না। সবচেয়ে ভালো আছে লীগের আমলে দুহাত ভরে কামানো নির্মাতা শিল্পীরা। এদের অধিকাংশই দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছে। যা কামিয়েছে তা দিয়ে আশা করা যায় বাকি জীবন ভালোভাবেই এদের কেটে যাবে। কিন্তু যারা দেশে আটকে গেছে নানা কারনেই। তাদের ভবিষ্যত কি হবে? এরা বাচবে কেমনে? যদিও কেউ কেউ কাজ নেই বলে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা সমাবেশে ইদানীং মুখ দেখাতে যায়। নিজেকে রাজনীতির প্রমিনেন্ট লাইনে যুক্ত করে হয়তো দুই তিন হাজারের খাম নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু তাতে আর কতদিন? এর মধ্যে আবার কিছু সংখ্যক বুদ্ধিসুদ্ধি করে বিভিন্ন সরকারি সংস্থায় ঢুকে গেছে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে। এখন যা কামানোর সবই কামাচ্ছে তারা। এরাই একটু পরে এসে এই লেখার নিচে কমেন্ট করে জানান দেবে, আসলে আগের থেকে মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি এখন কত বেশি ভালো আছে। সরকারি ন্যারেটিভ যেমন হয় আরকি।
রাজনীতি সব খাইলো আমাদের। বিবেক খাইলো, শিল্প সত্তা খাইলো। বুদ্ধি সুদ্ধি সবই চেটেপুটে খেয়ে নিলো। আমরা শুধু পেটে ভাতে বেচে থাকার জন্য কেউ লীগ হইলাম, কেউ জামাত হইলাম, কেউ বিএনপি হইলাম। আর যারা কিছুই হইতে পারলাম না তারা থাকলাম বারোমাসি অভুক্ত।