মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে দেশে ‘নব্য ফ্যাসিবাদ’ দেখার কথা জানিয়ে আর কোনো সংস্কার চান না বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। বর্তমান সরকারকে দিয়ে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন সম্ভব হবে না বলেও মনে করছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার ঢাকার কাকরাইলে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মে দিবসের এক আয়োজনে এই মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগ সরকারে থাকাকালে বিরোধীদলীয় নেতা।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ‘নব্য ফ্যাসিবাদ’ দেখতে পারছেন জানিয়ে জাতীয় পার্টির নেতা বলেন, “যতদিন পর্যন্ত ‘নব্য ফ্যাসিবাদ’ বিতাড়িত না হবে, ততদিন আমাদের সংগ্রাম চলবে।”
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, “কোনো ফ্যাসিবাদী সিদ্ধান্ত আমরা দেখতে চাই না। যেহেতু আপনি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করতে পারছেন না, দয়া করে আপনি বিদায় হোন।”
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদেরকে নিয়ে যে বৈঠক করেন, সেখানে জি এম কাদেরও ছিলেন। সেদিন বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে আলোচনাতেও অংশ নেন তিনি। এরপর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপেও অংশ নেন জাতীয় পার্টির নেতা।
২০০৮ সাল থেকেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট অথবা সমঝোতা করে নির্বাচন করে আসলেও জি এম কাদের দাবি করেছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আন্দোলনে তার দলের নেতাকর্মীরাও অংশ নিয়েছেন, প্রাণও দিয়েছেন।
তবে সরকার পতন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরোধিতার মধ্যে জাতীয় পার্টিকে আর সংলাপে ডাকা থেকে বিরত থাকে অন্তর্বর্তী সরকার। জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ আখ্যা দিয়ে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলাও করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে জাতীয় পার্টির নেতার বিরুদ্ধেও আন্দোলনে প্রাণহানির ঘটনায় হত্যা, হত্যাচেষ্টা ও দুর্নীতির অভিযোগে মামলা হয়েছে, এরপর থেকে সরকারের সমালোচনায় মুখর তিনি।
আওয়ামী লীগকে ‘ফ্যাসিবাদী’ বলে আক্রমণ করে আসছিল বিরোধীরা। বর্তমান আমলে ‘নব্য ফ্যাসিবাদ’ দেখার কথা জানিয়ে জি এম কাদের বলেন, “আমরা এক ফ্যাসিবাদকে বিদায় করেছি আরেক ফ্যাসিবাদকে গ্রহণ করতে নয়।
“আমরা এই ‘নব্য ফ্যাসিবাদের’ বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াব। আমরা ‘নব্য ফ্যাসিবাদ’ ও তাদের দোসরদের রুখে দেবো।”
জাতীয় পার্টির কর্মসূচিতে বাধা দেয়া, নেতাকর্মীদের উপর হামলা, মামলা ও নির্যাতন অভিযোগ তুলে জিএম কাদের বলেন, “আমরা আর অন্যায় অত্যাচার সহ্য করব না।…সরকারের ক্ষমতা আর মববাজি দিয়ে দেশের মানুষের উপর অত্যাচার চালাবে আমরা তা মেনে নেব না।”
‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ আখ্যা দিয়ে অনেক কলকারখানা জ্বালিয়ে দেওয়ার অভিযোগও আনেন জাতীয় পার্টির নেতা। তিনি বলেন, “ক্ষতিগ্রস্ত মিল কারখানা চালু করে শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে। মালিকপক্ষ যে দলই করুক শ্রমিকরা কাজ হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে।”
‘আপনি চলে যান’
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর আস্থা না থাকার কথাও বলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, “আমরা মনে করেছিলাম, সরকার নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে। অন্তবর্তীকালীন সরকার প্রধানের বিশ্বব্যাপী সুনাম আছে। আমরা ওনার উপর আস্থা রেখেছিলাম, আমরা নিরাশ হয়েছি।”
ইউনূসকে উদ্দেশ করে জি এম কাদের বলেন, “আপনি চলে যান, আপনাকে দিয়ে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন সম্ভব হবে না। আপনার দ্বারা কোনো সংস্কার আমরা বিশ্বাস করি না। যারা সংস্কার করছেন, তারা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট জানেন না।
“আবারও বলছি, এই মুহূর্তে অবাস্তব সংস্কার চাই না। নির্বাচিত সরকার ছাড়া কেউই সংস্কার করতে পারবে না।”
ইউনূস সরকারের গঠন করা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের বিষয়ে জি এম কাদের বলেন, “আপনারা সংস্কার প্রস্তাবগুলো টেবিলে রেখে যান, পরবর্তী নির্বাচনে যারা ক্ষমতায় আসবে তারাই সংস্কার করবে।”
যারা সংস্কার প্রক্রিয়ায় আছেন তারা দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও আর্থ সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে জানেন না বলেও মন্তব্য করেন জাতীয় পার্টি নেতা। তিনি বলেন, “তারা কিছু তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে কিছু সংখ্যক মানুষের সাথে আলাপ করছেন। দেশকে বিভক্ত করে, অর্ধেক মানুষকে বাদ দিয়ে কোনো সংস্কারই সফল হবে না। সংস্কারের নামে বর্তমান সরকার দেশের মাঝে অনৈক্য সৃষ্টি করেছে।”
‘আপনারা অর্ধেক মানুষের প্রতিনিধিত্বকারীদের ভোটাধিকার চান না’
আগামী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জাতীয় পার্টিকেও অংশ নিতে না দেওয়ার যে দাবি তোলা হচ্ছে সেই বিষয়ে ও কথা বলেন জি এম কাদের।
এই দাবির তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেন, “আপনারা দেশের অর্ধেক মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর ভোটাধিকার দিতে চান না, আমরা আপনাদের ওই চিন্তার ধার ধারি না। আমরা এ দেশের সন্তান, এ দেশের জন্য আমাদের ত্যাগ আছে।
“দেশের মানুষ যদি আমাদের গ্রহণ না করে আমরা মাথা পেতে নেব, কিন্তু আপনারা আপনাদের সুবিধার জন্য আমাদের রাজনীতি বাধাগ্রস্ত করবেন তা মেনে নেব না।”
কোনো কারণ ছাড়াই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে বের করে দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ এনে জাতীয় পার্টির নেতা বলেন, “কোন আইনে রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখবেন? কেউ দোষ করলে এটা তার দল বা ধর্মের দোষ নয়। আপনারা কাউকে নির্বাচন থেকে বাদ দিতে পারবেন না। সবাইকে নিয়েই নির্বাচন করতে হবে।”
ইউনূস ও তিনি যাদেরকে ‘নিয়োগকর্তা বলেছেন, তাদেরকে ক্ষমতা ছেড়ে রাজনীতিতে আসার আহ্বান জানান জি এম কাদের। বলেন, “জনগণ যদি তাদের গ্রহণ করে জাতীয় পার্টিও তাদের গ্রহণ করবে।”
নতুন দল চাঁদাবাজি ও শোডাউনের রাজনীতিতে
নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি ‘পুরনো স্টাইলে’ আগাচ্ছে বলেও মনে করেন জি এম কাদের।
তিনি বলেন, “সংস্কারের নামে একটি দল করা হয়েছে। তারা চাঁদাবাজির মাধ্যমে পুরনো সংস্কৃতি লালন করছে। সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করে চাঁদাবাজির মাধ্যমে শো-ডাউনের রাজনীতি শুরু করেছে ‘সরকারের’ নতুন দলটি।
“চাঁদাবাজি ও শোডাউনের রাজনীতি করতে গিয়ে তারা কাকের গায়ে ময়ূরের পালক লাগিয়েছে। তারা দেশের পরিবর্তনের জন্য কোনো কাজ করছে না।”
সংস্কৃতি উপদেষ্টাকে প্রশ্ন করার পর তিন সংবাদকর্মীর চাকরিচ্যুতি নিয়েও কথা বলেন জাতীয় পার্টির নেতা। তিনি বলেন, “সাংবাদিকরা রাজনীতিবিদদের প্রশ্ন করে, এটাই স্বাভাবিক। সে জন্য সাংবাদিকদের চাকরি চলে যাবে, টিভি স্টেশন বন্ধ হয়ে যাবে এমন কালচার আমরা দেখতে চাই না।”