ইশরাকদের মেয়র হওয়ার পথ বন্ধ চায় এনসিপি
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে আওয়ামী লীগ শাসনামলে হওয়া সব নির্বাচন বাতিলের প্রস্তাব করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। দলটি বলছে, এটি না করার কারণে আদালতে গিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি করা হচ্ছে।
বিএনপির পক্ষ থেকে ছাত্র উপদেষ্টাদেরকে অপসারণে যে দাবি তোলা হয়েছে, তারও বিরোধিতা করেছে গণঅভ্যুত্থানের নেতাদের দলটি। বলা হয়েছে, এই উপদেষ্টারা সরকারে যোগ দিয়ে সরকারের বৈধতা দিয়েছে।
শনিবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় আধা ঘণ্টার বৈঠক শেষে বের হয়ে সাংবাদিকদেরকে এসব কথা বলেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
এনসিপি নেতা বলেন, “শেখ হাসিনার শাসনামলে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে সব নির্বাচনকে আমরা অবৈধ ঘোষণা করতে বলেছি। কারণ, সেই সময়টায় শেখ হাসিনা ‘ফ্যাসিবাদী’ শাসন ব্যবস্থায় নির্বাচন করেছিল এবং মানুষের ভোটাধিকার হরণ করেছিল। রাতের ভোট হয়েছে, ডামি প্রার্থীর ভোট হয়েছে। ফলে সেই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে এবং সে সময়ের বিরোধী দলগুলো এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে।
“আমরা মনে করে সেই নির্বাচনগুলোকে আদালতে নিয়ে গিয়ে পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। সেই বিশৃঙ্খলা এড়াতে সেই নির্বাচনগুলোকে আইনগতভাবেই যেন অবৈধ ঘোষণা করা হয়।”
আওয়ামী লীগ শাসনামলে হওয়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ করে বিএনপি নেতা শাহাদাত হোসেন গত নভেম্বরেই বন্দরনগরীর মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ করে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন আদালতের রায় পেয়েও এখনও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে বসতে পারেননি। গত মার্চে রায় পাওয়ার পর সেই আদেশ চ্যালেঞ্জ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এক ভোটারের রিট আবেদনও খারিজ হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। আর এর আগে ইশরাক সমর্থকরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা ঘেরাও কর্মসূচি দিয়ে রাজধানীতে প্রচণ্ড জনদুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আওয়ামী লীগ শাসনামলে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির ভোট চ্যালেঞ্জ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেব শপথ নেওয়ার রায় পেয়েছেন বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন। তার সমর্থকদের আন্দোলনের কারণে রাজধানীতে ব্যাপক জনদুর্ভোগও হয়েছে গত সপ্তাহে।
ইশরাক প্রশ্ন রেখেছেন, আদালতের রায় পেয়েও তিনি কেন মেয়র হতে পারবেন না। গত বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের রায় পাওয়ার পর তিনি দুই উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মাহফুজ আলমের অপসারণও দাবি করেন। দাবি আদায়ে ৪৮ ঘণ্টা সময়ও বেঁধে নেন।
দুদিন পর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে গিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকেই এই দুই উপদেষ্টার অপসারণ দাবি করা হয়। তাদেরকে ‘বিতর্কিত’ আখ্যা দিয়েছে দলটি। দাবি করেছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এটা প্রয়োজন।
তবে বিএনপির এই দাবির বিরোধিতা করে নাহিদ ইসলাম বলেন, “আমরা বলেছি, ছাত্র প্রতিনিধি যারা ছিলেন, তারা গণঅভ্যুত্থানের প্রতিনিধি, সেই প্রক্রিয়ায় তারা সরকারকে বৈধতা দিয়েছেন।”
তাদের সঙ্গে কোনো দলের, এনসিপিরও সম্পর্ক নাই, সেটা সকালের সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট করার কথাও বলেন এনসিপির আহ্বায়ক।
তিনি বলেন, “বরং গণঅভ্যুত্থানের প্রতিনিধি হিসেবে তারা গিয়েছে, গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে কাজ করছে, সেখানে তাদেরকে হেয় করা, তাদেরকে অপমান করা, সে বিষয়ে আমরা নিন্দা জানিয়েছি।
“আমাদের সঙ্গে জড়িয়ে তাদেরকে ট্যাগ দেওয়াটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক, এটা আমরা বলেছি।”
বিএনপির আরও দাবির ‘বিরোধিতা’
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নেই কথা বলেছে। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিও জানিয়েছে। তবে এনসিপি চায় আগে হোক স্থানীয় নির্বাচন।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ চেয়েছে। তবে এনসিপি চায় আগে হোক স্থানীয় নির্বাচন। নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠনের দাবিও আছে তাদের।
নাহিদ ইসলাম বলেন, “আমরা বলেছি, নির্বাচন কমিশনের প্রতি আমরা আস্থা রাখতে পারছি না রাজনৈতিক দল হিসেবে। সেই ইলেকশন কমিশন পুনর্গঠন করে যাতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দ্রুত আয়োজন করা হয়। এর ফলে নাগরিক সেবার যে দুর্ভোগটি হচ্ছে, নাগরিক সেবা পাচ্ছে না জনগণ, সেটি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।”
ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার যে বক্তব্য সেই অবস্থানে এনসিপির সমর্থন তুলে ধরেন তিনি। তবে নির্বাচন নিয়ে একটি সমন্বিত রোডম্যাপ চেয়েছে দলটি।
নাহিদ ইসলাম বলেন, “জুলাই গণহত্যার বিচার ও যে সংস্কার প্রক্রিয়া চলমান, সংস্কারের জুলাই সনদ ঘোষণা হওয়ার কথা এবং যে নির্বাচনের কথা বলছি, গণপরিষদ ও আইন সভার নির্বাচন, সেই তিনটির একটি সমন্বিত পরিকল্পনা যেন সরকার ঘোষণা করে।”
এনসিপি নেতা এই বিষয়টি আবার স্পষ্ট করে বলেন, “আমরা বলেছি বিচার কোন প্রক্রিয়ায় হবে এবং নির্বাচন ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে হওয়ার কথা, সেটার ব্যাপারে যেন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়।”
ইউনূসকে সমর্থন
এটি তিন দিনের ব্যবধানে এনসিপি নেতাদের সঙ্গে ইউনূসের দ্বিতীয় বৈঠক। গত বৃহস্পতিবার নাহিদ তার দলের মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীকে নিয়ে যমুনায় যান।
দিনই গুঞ্জন ছড়ায় যে, ইউনূস পদত্যাগ করতে আগ্রহী। এনসিপির দুই নেতা যমুনায় যান ইউনূসকে পদত্যাগ না করার আহ্বান জানাতে।
সেদিন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্দেশ করে সর্বদলীয় বৈঠকের আহ্বান জানান। রবিবার সেই বৈঠক আহ্বানের তথ্য মিলেছে।তার আগে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা।
নাহিদ ইসলাম বলেন, “আমরা প্রথমেই ইউনূসের প্রতি সমর্থন জানিয়েছি, আহ্বান জানিয়েছে, গণঅভ্যুত্থানের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন, সেই দায়িত্ব সম্পন্ন করেই যাতে উনি সিদ্ধান্ত নেন যে কোনো বিষয়ে।
“আমরা বলেছি ওনি যাতে দায়িত্বে থাকেন এবং দায়িত্বে থেকে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করেন।”
প্রধান উপদেষ্টাকে সর্বাত্মক সমর্থন জানিয়ে এনসিপি নেতারা তাকে বলেছেন, গণঅভ্যুত্থানের সব প্রতিশ্রুতি শেষ করেই যেন তিনি দায়িত্ব শেষ করেন।
কোনো রাজনৈতিক দল না, জনগণ এবং অভ্যুত্থানকারী ছাত্র জনতার আহ্বানে তিনি এসেছেন বলে মন্তব্য করে এনসিপি নেতা বলেন, “সেই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে উনি কমিটেড, কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি কমিডেট না। এই বিষয়টা যাতে উনি বিবেচনা করেন যে কোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে।”
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহতদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া ধীরগতিতে আগাচ্ছে বলেও অভিযোগ করে এনসিপি। জানায়, এখনও সব পরিবার সঞ্চয়পত্র পায়নি, মাসিক ভাতা এখনও শুরু হয়নি। সেগুলো যেন দ্রুত করা হয়।
প্রধান উপদেষ্টার আশ্বাস
বিএনপি যেসব বক্তব্য রেখেছে, সে বিষয়ে সরকারের তরফে কোনো আশ্বাস না এলেও এনসিপিকে প্রধান উপদেষ্টা আশ্বাস দিয়েছেন বলেও জানান নাহিদ ইসলাম।
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনে জুলাই ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের দাবি ছিল। সরকারের পক্ষ থেকে ৩০ কার্যদিবসের কথা বলা হয়েছিল। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যেন জুলাই ঘোষণাপত্র জারি করা হয়, সে বিষয়ে আমরা আহ্বান জানিয়েছি। সরকারের পক্ষ থেকে আমাদেরকে আশ্বস্ত করা হয়েছে।
“জুলাই মাসের মধ্যে জুলাই সনদ আসতে পারে, আসবে, এমন একটি আশ্বাস আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে।”
প্রধান উপদেষ্টা আর কী বলেছেন, এই প্রশ্নে এনসিপি নেতা বলেন, “সংস্কারের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশ করা সম্ভব। তবে সেই নতুন বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি থেকে কোনো কোনো পক্ষ সরে আসছে বলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মনে হচ্ছে এবং ওনাকে চাপ প্রয়োগ করে বিভিন্ন দাবি আদায়ের চেষ্টা চলছে। এর ফলে ওনার পক্ষে এইভাবে কাজ করা সম্ভব নয়, সংস্কার বা পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়।
“সেই জায়গা থেকে উনি হতাশা ব্যক্ত করেছেন। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা বলেছি, ওনি যেন কোনো রাজনৈতিক দল নয়, জনগণের প্রতি এবং অভ্যুত্থানকারী ছাত্র জনতার প্রতি কমিটেড হন এবং ওনি ওনার দৃঢ়তা প্রদর্শন করেন।”