মৌলবাদের ‘উত্থান’ নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন ‘একপেশে’: সরকার

32

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ‘রাজনৈতিক শূন্যতার’ সুযোগে বাংলাদেশ ধর্মীয় মৌলবাদীদের দখলে চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বলে নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় এই প্রতিবেদনকে ‘একপেশে’ বলা হয়েছে।

- Advertisement -

- Advertisement -

বাংলাদেশ যখন নিজেকে পুনরুজ্জীবিত করছে, তখন ‘ইসলামি কট্টরপন্থিরা সুযোগ দেখছে’ শিরোনামে প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক কমিটির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামও বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করেননি। ইসলাম ধর্মভিত্তিক দলগুলোও পরিস্থিতিতে ‘সুযোগ হিসেবে’ দেখছে বলেও সংবাদে বলা হয়ে।

বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থান তুলে ধরতে বেশ কয়েকটি ঘটনা সামনে এনেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস। রংপুরের তারাগঞ্জে স্থানীয় ইসলামী আন্দোলনের দাবির মুখে নারীদের ফুটবল ম্যাচ স্থগিত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে এসেছে তারা। প্রতি বছর সেখানে নারীদের ফুটবল খেলা হলেও এবারই তা বন্ধের দাবি উঠল। যা অনেকটা ‘নজিরবিহীনই’ বলা হয়েছে সেই প্রতিবেদনে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে হয়রানি করার অভিযোগে আটক এক ব্যক্তিকে ‘ইসলামপন্থিরা’ যে মুক্ত করে এনেছেন, সেই বিষয়টিও এসেছে প্রতিবেদনে।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে লেখা হয়, “নারী হেনস্থাকারীকে ছেড়ে দিতে শুধু বাধ্যই করেনি ইসলামপন্থি জনতা, তারা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ফুলের মালা দিয়েও বরণ করে নিয়েছিল।”

পত্রিকাটি আরও বলছে, “কার্যত উগ্রপন্থীরা নারীর উপর নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন। যেসব সাধারণত আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে হয়ে থাকে। অথচ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীদের অবদান একেবারে কম নয়। দেশটির শ্রমশক্তির ৩৭ শতাংশ নারী, তাদেরকে ঘরে বন্দি করে রাখার চেষ্টা সরাসরি দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশ পিছিয়ে যাবে।”

লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট রাহুল রাহার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগের বিষয়টিও এসেছে প্রতিবেদনটিতে, যেখানে ঢাকায় এক সমাবেশে বিক্ষোভকারীরা দাবি করেছিলেন, সরকার যদি ইসলামকে অসম্মানকারী ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড না দেয়, তবে তারা নিজ হাতেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে।

নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহরীরের প্রকাশ্যে রাজপথে নেমে আসার বিষয়টিও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

শেখ হাসিনাকে যেদিন ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, সেদিন রাতেই আহমাদিয়া সম্প্রদায়ের উপাসনালয়ে হামলার ঘটনা ঘটে। আহমাদিয়া সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা আতঙ্কে আছেন। আহমাদিয়ার এক স্থানীয় নেতা শফিকুল ইসলাম বলেছেন, “জনগণের থেকে কোনো সমস্যা নেই। তারা শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু ধর্মীয় নেতারা সরাসরি আহমাদিয়ার বিরুদ্ধে।”

নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন জনগণ দেখছে, তার আড়ালে ইসলামপন্থি নেতারা একটি ইসলামি সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যার আলোকে তারা ইসলামকে অসম্মান করা ব্যক্তি ও পর্দার খেলাপ করা নারীদের শাস্তি দিতে পারে।

সাক্ষাৎকারে বেশ কয়েকটি ইসলামপন্থি দল খোলাখুলি এমন ইচ্ছার কথাও বলেছে। এর মধ্যে অনেকে রয়েছেন, যারা শেখ হাসিনার আমলে কারাগারে ছিলেন, কিন্তু এখন তারা মুক্ত।

ফলে মুহাম্মদ ইউনূসের সমালোচক অনেকেই ভাবছেন, তিনি নিজে সেক্যুলার চিন্তা ভাবনার হলেও মৌলবাদের ইস্যুতে তার ভূমিকা অনেক ‘নরম’। হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে যোগদানকারী অনেকেও তার ভূমিকায় অসন্তুষ্ট বলেও লেখা হয় নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে।

এতে লেখা হয়, মৌলবাদীদের ‘তোষণ’ সেসব নারী শিক্ষার্থীদের অসন্তুষ্ট করছে, যারা নিপীড়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সাহায্য করেছিল।

এই বিক্ষোভকারীরা চেয়েছিল কার্যত ‘একদলীয়’ শাসনকে গণতন্ত্র দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে। অথচ তারা এখন নিজেদের এমন এক ধর্মভিত্তিক জনতাবাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেখছে, যারা নারী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও কাদিয়ানীদের মতো সম্প্রদায়কে চাপে রাখতে চায়।

বর্তমান পরিস্থিতিতে খুশি নন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক শেখ তাসনিম আফরোজ এমি। ২৯ বছর বয়সী এই নারী নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, “আমরা বিক্ষোভের সামনের সারিতে ছিলাম। আমরা রাস্তায় আমাদের ভাইদের রক্ষা করেছি। এখন পাঁচ, ছয় মাস পরে- পুরো জিনিসটি ঘুরে গেল।”

নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, বাংলাদেশের নতুন সংবিধানের খসড়া যারা করছেন, তারা স্বীকার করেছেন সংবিধানে উল্লেখিত ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ যেতে পারে। তবে তারা এটিকে বহুত্ববাদ দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে চান। কিন্তু মৌলবাদ নিয়ন্ত্রণে এটি কতটুকু ভূমিকা রাখবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কার্যত ‘পুলিশি রাষ্ট্র’ চালিয়েছিলেন উল্লেখ করে প্রতিবেদনে লেখা হয়, “তিনি (শেখ হাসিনা) যেমন ইসলামপন্থিদের কঠোরভাবে দমন করেছিলেন, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের ‘তোষণও’ করেছিলেন। মাদ্রাসা ও মসজিদ স্থাপনের জন্য তিনি ১২ হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচ করেছিলেন। যা অনেক ক্ষেত্রেই মৌলবাদ বিকাশের ভিত্তি হিসেবে দাঁড়িয়েছে।”

হাসিনার পতনের পর ছোটো ছোট উগ্রপন্থী দলগুলো বর্তমান ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে উলটে দিতে চায় বলে মন্তব্য করে নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, “কিছু মূল ধারার ইসলামপন্থি দল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই কাজ করতে চায়। তবে রক্ষণশীল বাংলাদেশ গঠনে দুই পক্ষই কার্যত একই নৌকার মাঝি।

দেশে ধর্মভিত্তিক সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল জামায়াত ইসলাম বর্তমান পরিস্থিতিতে বড় সুযোগ দেখতে পাচ্ছে বলেও মত দিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কূটনীতিকদের বরাত দিয়ে লেখা হয়, “বড় আকারের ব্যবসায়িক বিনিয়োগের মালিক এই দলটি ‘দীর্ঘমেয়াদি খেলা’ খেলছে।”

প্রতিবেদনে লেখা হয়, বছরের শেষ দিকে জাতীয় নির্বাচন হলে জামায়াতের জয়ের কোনো সম্ভাবনাই নেই, তবে দলটি আশা করছে- নির্বাচন যত পেছাবে, সেক্যুলার ভাবধারার দলগুলোর জনপ্রিয়তা তত কমবে।

জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক মিয়া গোলাম পরওয়ার নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, তার দলের চাওয়া ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র। ধর্ম ও রাজনীতির মিশ্রণে তুরস্ক হচ্ছে এর সবচেয়ে কাছাকাছি মডেল।

তিনি বলেন, “ব্যবহার ও নৈতিকতার আলোকে ইসলাম পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্যই কিছু নীতিমালা দিয়েছে। এগুলো মেনে নারীরা খেলাধুলা, গান, অভিনয়, বিচার বিভাগ, সামরিক বাহিনী ও আমলাতন্ত্রসহ যেকোনো পেশায় নিজেকে যুক্ত করতে পারে।”

তবে ছোট ধর্মীয় দলগুলোর অবস্থান এতটা সহনশীল নয় বলে মনে করে নিউ ইয়র্ক টাইমস। সাক্ষাৎকারে বেশ কয়েকটি ইসলামপন্থি দলের নেতারা খোলাখুলি মৌলবাদ প্রতিষ্ঠা করার কথা বলেছেন।

তথ্য উপদেষ্টার পদ ছেড়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির আহ্বায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করা নাহিদ ইসলাম নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, “দেশ চরমপন্থার দিকে চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে।”

যদিও ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পরিচিতি পাওয়া নাহিদ আশা করেন, গণতন্ত্র ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মতো মূল্যবোধ ধরে রাখতে পারবে বাংলাদেশ।

তবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার প্রকাশিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রতিবেদনটিকে ‘উদ্বেগজনক ও একপেশে’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এতে বলা হয়, “ভুল চিত্র তুলে ধরে এমন বাছাই করা উসকানিমূলক ঘটনা না টেনে গত এক বছরে বাংলাদেশ যে অগ্রগতি অর্জন করেছে তা দেখা উচিত।”

পরিস্থিতির জটিলতা স্বীকার করাটাও গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর।

You might also like