গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রশ্নে এখনও ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ।
সোমবার জাতীয় সংসদের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অগ্রগতি সম্পর্কে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রথম দফা আলোচনা শেষে সংবিধান সংস্কারসহ পাঁচ কমিশনের সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য এবং আংশিক ঐকমত্যের বিষয়গুলো আলাদাভাবে তুলে ধরেন আলী রীয়াজ।
তবে বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণের কাঠামো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন, একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কতবার নির্বাচিত হতে পারবেন, একজন সংসদ সদস্য কতগুলো পদে থাকতে পারবেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়া কী হবে, সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়া কী হবে এই ধরনের মৌলিক কাঠামোগত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অমীমাংসিত রয়েছে জানান তিনি।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ক্ষমতঅয় বসা অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে দুই ধাপে ১১টি কমিশন গঠন করে।
কমিশনগুলোর সুপারিশ নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের উদ্দেশ্যে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম শুরু হয়। সেদিন ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বিএনপিসহ সবগুলো রাজনৈতিক দলের প্রথম বৈঠক হয়।
এরপর সংবিধান সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর ওপর ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মতামত জানতে চায় ঐকমত্য কমিশন। পরে মতামত তুলে ধরে ৩৪টি দল, যাদের সঙ্গে এখন আলাদা করে বৈঠক করছে কমিশন।
সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়। প্রতিবেদনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ স্প্রেডশিট আকারে দেওয়া হয়।
এসব সুপারিশ নিয়ে প্রথম দফায় রাজিনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শেষ করেছে ঐকমত্য কমিশন। কিছু বিষয় ‘অমিমাংসিত’ থাকায় দ্বিতীয় ধাপে জুন মাসে আবারও দলগুলোর সঙ্গে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছে কমিশন।
মঙ্গলবার আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ সংবিধানিক প্রশ্নে এখনও ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি। এর মধ্যে সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়াসহ কয়েকটি মৌলিক কাঠামোগত বিষয় অমীমাংসিত থাকায় দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ আয়োজন করা হবে।
ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার পর তা কীভাবে বাস্তাবায়িত হবে- এক সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, “বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই নির্ধারণ করবে। ঐকমত্য কমিশনের সুর্নিদিষ্ট প্রস্তাবনা নেই।”
মৌলিক কাঠামোগত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অমীমাংসিত থাকলে কমিশনের উদ্দেশ্য ব্যহত হবে কি না-প্রশ্নে তিনি বলেন, “সংস্কার বাস্তাবায়ন করার ক্ষমতা কমিশনের নেই, রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবে। ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার বিষয়ে এক ধরনের ঐকমত্য আছে। প্রক্রিয়া পদ্ধতি কী হবে এটি নিয়ে দ্বিতীয় দফার আলোচনা হবে। আশাকরি তারা (রাজনৈতিক দলগুলো) এটি অনুধাবন করতে পারবেন।”
যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি বা দলগুলোর অবস্থান কাছাকাছি সেসব বিষয় নিয়ে দ্বিতীয় দফা আলোচনার শুরুর প্রস্তুতির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “সংস্কারের ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে খুব শিগগিরই দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা শুরু করতে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।”
জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয়ত পর্যায়ের আলোচনা শুরুর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এ ধাপে আলোচনা হবে বিষয়ভিত্তিক। যেসব প্রধান প্রধান বিষয়ে ভিন্নমত আছে সেগুলো নিয়ে বসার পরিকল্পনা করছি।”
সংবিধান সংস্কার কমিশনের বেশ কিছু সুপারিশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নীতিগত ঐকমত্য রয়েছে জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, “সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে আরও আলোচনার প্রয়োজন আছে। তবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় কোনো দ্বিমত নেই। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট করার জন্য অধিকাংশ দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে।”
তবে কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য এবং অতিরিক্ত আলোচনা প্রয়োজন জানিয়ে তিনি বলেন, “রাষ্ট্রের মূলনীতিতে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার ও গণতন্ত্র’ অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে ঐকমত্য থাকলেও ‘বহুত্ববাদ’ বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে। নাগরিক অধিকার সম্প্রসারণে নীতিগত ঐক্য থাকলেও রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতার মাত্রা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠনের বিষয়ে অধিকাংশ দল একমত হলেও কিছু দল এককক্ষীয় ব্যবস্থার পক্ষে।”
“নারীদের জন্য ১০০ আসন সংরক্ষণের পক্ষে ঐকমত্য থাকলেও পদ্ধতি নিয়ে মতবিভেদ রয়েছে। ডেপুটি স্পিকারের পদ বিরোধী দলকে দেওয়ার প্রস্তাবে সর্বসম্মতি আছে। উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনে ভোটের আনুপাতিক হারের ভিত্তিতে নির্বাচন প্রস্তাবে একমত নয় সবাই। ৪৮(ক) অনুচ্ছেদ সংশোধনে দলগুলো একমত হলেও রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছে। ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের বিষয়ে সম্মতি থাকলেও কোনো বিষয়ে দলীয় শৃঙ্খলা বাধ্যতামূলক হবে তা নিয়ে আংশিক ঐকমত্য রয়েছে। সংসদের গুরুত্বপূর্ণ কমিটিগুলোর সভাপতিত্ব বিরোধী দলের হাতে দেওয়ার প্রস্তাবেও বেশিরভাগ দল একমত।”
কমিশন প্রস্তাবিত সংস্কার সংক্রান্ত সুপারিশগুলোর মধ্য থেকে নির্বাচিত কিছু বিষয়ে জনগণের মতামত জানতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মাধ্যমে একটি জরিপ পরিচালনার ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানান আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, “যে সুপারিশগুলো সম্পর্কে রাজনৈতিক দলের মতামত নেওয়া হয়েছে সেগুলোর মধ্য থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশসমূহ সম্পর্কে জনগণের মতামত নেওয়ার উদ্দেশ্যেই এই জরিপ পরিচালনা করা হবে।”
জরিপের বিষয়বস্তু এবং প্রক্রিয়া কেমন হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সংবিধান সংস্কার কমিশন এবং আরও দুটি কমিশন প্রায় ৪৬ হাজারের বেশি ঘরে জরিপ চালিয়েছিল। আমরা সেটাই ব্যবহার করতে চাচ্ছি। কী কী বিষয়ে এবারের জরিপে থাকবে তার জন্য প্রশ্ন তৈরি করতে হবে।”
বহুত্ববাদ প্রশ্নে দলগুলোর ভিন্নমত রয়েছে জানিয়ে সংবিধানে এটি থাকবে কি না প্রশ্ন করেন গণমাধ্যমকর্মীরা। জবাবে আলী রীয়াজ জানান, আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলো বহুত্ববাদেও মৌলিক জায়গায় একমত। তবে সংবিধানে এটির অবস্থান বিভ্রান্তি ও ভিন্নমত তৈরি করতে পারে মন্তব্য করে দলগুলো এটি বাদ দেওয়ার দাবি উঠেছে বলে জানান তিনি।
আলী রীয়াজ বলেন, “বিকল্প হিসেবে কেউ ভিন্ন শব্দ ব্যবহারের কথা বলেছেন। সংবিধান সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার জন্য একটি ক্লজের কথা বলা হয়েছে। সব ধরনের বৈচিত্রকে ধারণ করার প্রতিশ্রুতির কথা বলা হচ্ছে। এ বিষয়ে অধিকাংশ দলই এ বিষয়ে একমত। আমরা আশা করি যে সংস্কারের মধ্য দিয়ে সরকারের এই অঙ্গীকার থাকবে।”
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ইফতেখারুজ্জামান, মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
You might also like

সম্পাদক :মোঃ শাহজালাল
২০২৫ © ব্যানারনিউজবিডি কর্তৃক সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
🚧 এই সাইটটি বর্তমানে নির্মাণাধীন 🚧
২০২৫ © ব্যানারনিউজবিডি কর্তৃক সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
🚧 এই সাইটটি বর্তমানে নির্মাণাধীন 🚧
You cannot print contents of this website.