‘মার্চ টু এনবিআর’ ও ‘কমপ্লিট শাটডাউন’সহ টানা দেড় মাস ধরে চলা সব ধরনের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে অবশেষে কাজে ফিরেছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
সোমবার সকাল থেকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের রাজস্ব ভবনসহ সারা দেশের শুল্ক ও কর কার্যালয়ে পুরোদমে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এতে স্থবির হয়ে পড়া আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে গতি ফিরেছে, বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও বেনাপোল বন্দরে কর্মচাঞ্চল্য দেখা গেছে।
সকালে রাজস্ব ভবনে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা অফিসে এসেছেন। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে এনবিআর কার্যালয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি এখনও লক্ষ্য করা গেছে। এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খানও সকালে কার্যালয়ে এসেছেন বলে জানা গেছে।
কর্মসূচি প্রত্যাহারের ফলে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর ও স্থলবন্দরগুলোতে স্বস্তি ফিরেছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক দেশকাল নিউজ ডটকমকে বলেন, “বন্দরে কনটেইনার ডেলিভারিসহ সব কার্যক্রম এখন পুরোপুরি সচল। যেসব অতিরিক্ত কনটেইনার জমে গিয়েছিল, সেগুলো দ্রুত ছাড় করা হবে।”
বেনাপোল স্থলবন্দরেও পুরোদমে শুরু হয়েছে আমদানি-রপ্তানি ও পণ্য খালাস কার্যক্রম। দুই দিন বন্ধ থাকার পর সোমবার সকাল থেকেই চার হাজারেরও বেশি হ্যান্ডলিং শ্রমিক কাজে যোগ দিয়েছেন। ব্যস্ত সময় পার করছেন কাস্টমস ও বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
বেনাপোল বন্দরের পরিচালক শামীম হোসেন বলেন, “এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের শাটডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহারের ফলে সকাল থেকেই আমদানি-রপ্তানির প্রক্রিয়া স্বাভাবিকভাবে শুরু হয়েছে। যানজট ও পণ্যজট নিরসনে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের দ্রুত কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
আন্দোলনের শেষ দিকে দুই দিনের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে বেনাপোল বন্দরে বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধ থাকায় সরকার প্রায় ৫০ কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
বেনাপোল আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি আলহাজ মহসিন মিলন বলেন, “এনবিআরের বিরুদ্ধে ‘মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২৮ ও ২৯ জুন বেনাপোল বন্দরে আমদানি-রপ্তানি সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। এর ফলে দুই দেশের বন্দরে প্রায় ২ হাজার পণ্যবাহী ট্রাক আটকে পড়ে। মাত্র দুই দিন বাণিজ্য বন্ধ থাকায় সরকার প্রায় ৫০ কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে।”
বেনাপোল কাস্টমস হাউসের সহকারী কমিশনার রাজন হোসেন বলেন, “কর্মসূচি প্রত্যাহারের পর শুল্কায়ন ও পণ্য ডেলিভারি কার্যক্রম দ্রুত গতিতে শুরু হয়েছে। বন্ধকালীন রাজস্ব ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কাস্টমস কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত সময় কাজ করতে বলা হয়েছে।”
যেভাবে কাটল অচলাবস্থা
এর আগে রবিবার রাতে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’।
পরিষদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী নেতাদের অনুরোধে এবং আমদানি-রপ্তানি ও সরবরাহ ব্যবস্থা সচল রাখা তথা অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থে ও জনগণের কথা বিবেচনায় নিয়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হয়েছে।
এনবিআরকে দুই ভাগ করে ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা’ ও ‘রাজস্ব নীতি’ নামে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ করতে মে মাসে সরকার অধ্যাদেশ জারি করলে এর বাতিলের দাবিতে গত ১২ মের পর থেকে আন্দোলনে নামেন এনবিআর কর্মীরা। কলম বিরতি, অবস্থান ধর্মঘটসহ নানা কর্মসূচির কারণে সরকারের রাজস্ব আদায়কারী সংস্থাটিতে অচলাবস্থা তৈরি হয়।
আন্দোলনের মুখে সরকার পিছু হটে জানায়, অধ্যাদেশ বাস্তবায়নের আগে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। তবে আন্দোলনকারীরা এনবিআর চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে অটল থেকে তাকে কার্যালয়ে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করে।
দাবি আদায়ে শনিবার থেকে তারা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি শুরু করলে আমদানি-রপ্তানিসহ এনবিআরের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে।
এই প্রেক্ষাপটে সংকট নিরসনে এনবিআর কর্মীদের অবিলম্বে কর্মস্থলে ফেরার আহ্বান জানিয়ে কঠোর পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি দেয় সরকার। এরপর রোববার এনবিআরের সেবা খাতকে ‘অত্যাবশ্যকীয়’ ঘোষণা করা হয়।
পরে ব্যবসায়ী নেতারা অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং সেই বৈঠকের পর এনবিআর ঐক্য পরিষদকে আন্দোলন প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান।
একই দিনে এনবিআরের অচলাবস্থা নিরসনে পাঁচ উপদেষ্টাকে নিয়ে একটি কমিটি করে সরকার। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানকে প্রধান করে গঠিত এই কমিটিতে আরও আছেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন।
ঐক্য পরিষদ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সরকারি এই কমিটিকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, তারা এই কমিটির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করে টেকসই রাজস্ব সংস্কারে অবদান রাখতে পারবে বলে মনে করে।