প্রায় ৯ মাস পর মিরপুরে হোম অব ক্রিকেটে আন্তর্জাতিক ম্যাচ। কৃত্রিম আলোয় খেলা প্রায় ১৪ মাস পর। তাই সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসেও টসের আগেই ভরতে শুরু করল গ্যালারি। প্রথম ইনিংসের মাঝপথেই যেন নেই তিল ধারণের ঠাই। ম্যাচজুড়ে ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ স্লোগানে মাঠ মাতালেন গ্যালারিভর্তি দর্শকরা। তাদের হতাশ করেননি পারভেজ হোসেন, মুস্তাফিজুর রহমানরা। ব্যাটিং-বোলিংয়ে দাপুটে পারফরম্যান্সে দারুণ জয় পেল বাংলাদেশ।
বল হাতে ভিত গড়ে দেন মুস্তাফিজ। তুলনামূলক বোলিং সহায়ক উইকেটে বৈচিত্রের পসরা সাজিয়ে ৪ ওভারে মাত্র ৬ রান খরচায় ২ উইকেট নেন অভিজ্ঞ বাঁহাতি পেসার। দারুণ সঙ্গ দেন অন্যরাও। যার যোগফল, টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকিস্তানের প্রথমবার অল আউটের নজির। পরে ব্যাট হাতে ঝড়ো ইনিংস খেলেন ওপেনার পারভেজ।
শের-ই বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে রোববার বাংলাদেশের জয় ৭ উইকেটে। ১১১ রানের লক্ষ্য ২৭ বল বাকি থাকতে ছুঁয়ে ফেলে স্বাগতিকরা। তিন ম্যাচ সিরিজে এগিয়ে যায় ১-০ ব্যবধানে।
টি-টোয়েন্টিতে এটিই বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকিস্তানের সর্বনিম্ন দলীয় স্কোর। এর আগের ২২ ম্যাচের একটিতেও তাদের ৭ উইকেটের বেশি নিতে পারেনি বাংলাদেশ।
পাকিস্তানের মূল দলের বিপক্ষে ৯ বছর পর জয় পেল বাংলাদেশ। রোববারের আগে বাংলাদেশের সবশেষ জয় ছিল ২০১৬ সালের এশিয়া কাপে। এছাড়া ২০২৩ সালের এশিয়ান গেমসে দুই দেশের দ্বিতীয় সারির দলের লড়াইয়ে জিতেছিল তারা।
টি-টোয়েন্টি ম্যাচে পূর্ণ ৪ ওভার বোলিং করা বাংলাদেশের বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে কম রান খরচের রেকর্ড গড়েন মুস্তাফিজ।
আগের রেকর্ডেও অবশ্য ছিল অভিজ্ঞ পেসারের নাম। ৪ ওভারে ৭ রান করে দিয়ে রেকর্ডটি ছিল মুস্তাফিজ, তানজিম হাসান ও রিশাদ হোসেনের।
এছাড়া এ নিয়ে এই সংস্করণে চার ম্যাচে ১০ রানের কম খরচ করলেন মুস্তাফিজ। বাংলাদেশ তো বটেই, আইসিসির পূর্ণ সদস্য দেশগুলোর মধ্যে পূর্ণ ৪ ওভার বোলিং করে চার ম্যাচে ১০ রানের কম খরচের রেকর্ড নেই কোনো বোলারের।
তবে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জেতেন ৩৯ বলে ৫৬ রানের ইনিংস খেলা পারভেজ। ৩ চারের সঙ্গে ৫টি ছক্কা মারেন আগের দুই ম্যাচে শূন্য রানে আউট হওয়া বাঁহাতি ওপেনার।
ম্যাচের শুরুটা বাংলাদেশ করে দীর্ঘ ৯ ম্যাচের টস না জেতার অপেক্ষা ঘুচিয়ে। উইকেট দেখে ভালো মনে হওয়ায়, রান তাড়ার সিদ্ধান্ত নেন লিটন।
ফিল্ডিংয়ে নেমে প্রথম ওভারেই ব্রেক থ্রু পেতে পারত বাংলাদেশ। শেখ মেহেদি হাসানের বলে ফাইন লেগে ফাখার জামানের সহজ ক্যাচ ছেড়ে দেন তাসকিন আহমেদ। তবে পরের ওভারে সাইম আইয়ুবকে ফিরিয়ে কিছুটা পুষিয়ে দেন অভিজ্ঞ পেসার।
মেহেদিকেও উইকেটের জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি। পরের ওভারে তাকে ছক্কা মারতে গিয়ে ডিপ মিড উইকেটে ক্যাচ দেন মোহাম্মদ হারিস।
তিন ওভারের মধ্যে দুজন ব্যাটসম্যান ফিরে গেলেও ৩২ রান নিয়ে তখন পর্যন্ত তেমন চাপে ছিল না পাকিস্তান। তবে পরের পাঁচ ওভারে সফরকারীদের চেপে ধরেন মুস্তাফিজ, মেহেদি, তানজিম হাসানরা।
চতুর্থ ওভারে সালমান আলি আগাকে রীতিমতো নাচিয়ে ছাড়েন তানজিম। টানা ৪টি ডট বল খেলার পর পঞ্চম বলে মরিয়া হয়ে স্কুপ খেলতে গিয়ে কট বিহাইন্ড হন পাকিস্তান অধিনায়ক। ৩ রান করতে ৯ বল খেলেন তিনি।
পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে হাসান নাওয়াজকে খালি হাতে ফেরান মুস্তাফিজ। এক ওভার পর রান আউট হয়ে ফেরেন মোহাম্মদ নাওয়াজ। মাত্র ৪৬ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে তখন বিপদে পাকিস্তান। চতুর্থ থেকে অষ্টম ওভার পর্যন্ত মাত্র ১৪ রানে ৩ উইকেট পড়ে তাদের।
শুরুতে জীবন পাওয়া ফাখার আবার জীবন পান দশম ওভারে, ৩০ রানে। অনেক জোরে আসা ফিরতি ক্যাচ নিতে পারেননি মেহেদি, মুখে আঘাতও পান তিনি। শেষ পর্যন্ত রান আউটে কাটা পড়েন বাঁহাতি ওপেনার। ৬ চার ও ১ ছক্কায় ৩৪ বলে করেন দলের সর্বোচ্চ ৪৪ রান।
ফাখারের বিদায়ে মনে হচ্ছিল একশ করতে পারবে না পাকিস্তান। খুশদিল শাহ ও আব্বাস আফ্রিদি পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করে দুই ওভারে মারেন চারটি ছক্কা। ১৬ ওভারে একশ পূর্ণ করে পাকিস্তান।
এরপর আবার সফরকারীদের পিছিয়ে যাওয়া। শেষ ৩.৩ ওভারে মাত্র ৮ রানে বাকি ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলে তারা। এর মধ্যে শেষ ওভারেই একটি রান আউট সহ তিন বলে হারায় শেষ ৩ উইকেট।
রান তাড়ায় বাংলাদেশের শুরুটা ছিল ভয় জাগানিয়া। প্রথম ওভারে অভিষিক্ত সালমান মির্জার বাড়তি বাউন্স করা ডেলিভারিতে ক্যাচ দেন তানজিদ হাসান। এক ওভার পর লিটনকেও ফিরিয়ে স্বাগতিকদের চাপে ফেলেন বাঁহাতি পেসার।
সেটা আরও বাড়তে পারত বাংলাদেশের। পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে ফাহিম আশরাফের বলে তাওহিদ হৃদয়ের ক্যাচ ছেড়ে দেন আবরার আহমেদ। হৃদয়কে দ্বিতীয় জীবন দেন মোহাম্মদ হারিস। আবরারের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ নিতে পারেননি তিনি।
দুবার বেঁচে গিয়ে সুযোগ কাজে লাগান হৃদয়। পারভেজের সঙ্গে তার জুটিতে আসে ৬২ বলে ৭৩ রান। লক্ষ্য বেশি বড় না হওয়ায় দুজনই ওয়ানডে মেজাজে এগোতে থাকেন।
১৩তম ওভারে এই জুটি ভাঙেন আব্বাস। বোল্ড হয়ে ড্রেসিং রুমের পথ ধরেন ৩৭ বলে ৩৬ রান করা হৃদয়।
এরপর যেন আর সময় নিতে চাননি পারভেজ। জাকের আলির সঙ্গে ১৮ বলে ৩২ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে চার ওভারের বেশি বাকি থাকতে ম্যাচ শেষ করে তরুণ ওপেনার।
১৪তম ওভারে ঝড় বয়ে যায় ফাহিমের ওপর। একটি চার মেরে পারভেজকে স্ট্রাইক দেন জাকের। টানা তিন বলে ৪, ৬ ও ৪ মেরে মাত্র ৩৪ বলে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ফিফটি পূর্ণ করেন বাঁহাতি ওপেনার।
পরে সালমান মির্জার বলে ম্যাচ জেতানো শটটি খেলেন জাকের।
একই মাঠে মঙ্গলবার সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে লড়বে দুই দল।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
পাকিস্তান: ১৯.৩ ওভারে ১১০ (ফাখার ৪৪, সাইম ৬, হারিস ৪, সালমান আগা ৩, হাসান নাওয়াজ ০, মোহাম্মদ নাওয়াজ ৩, খুশদিল ১৭, আফ্রিদি ২২, আশরাফ ৫, সালমা মির্জা ০, আবরার ০*; মেহেদি ৪-০-৩৭-১, তাসকিন ৩.৩-০-২২-৩, তানজিম ৪-০-২০-১, মুস্তাফিজ ৪-০-৬-২, শামীম ১-০-২-০, রিশাদ ৩-০-১৯-০)
বাংলাদেশ: ১৫.৩ ওভারে ১১২/৩ (তানজিদ ১, পারভেজ ৫৬*, লিটন ১, হৃদয় ৩৬, জাকের ১৫*; সালমান ৩.৩-০-২৩-২, সাইম ২-০-১৬-২, ফাহিম ৩-০-২৯-০, আবরার ৪-০-২০-১, আব্বাস ২-০-১৬-১, নাওয়াজ ১-০-৮-০)
ফল: বাংলাদেশ ৭ উইকেটে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: পারভেজ হোসেন