মাসব্যাপী ধারাবাহিক বৈঠকের পর ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ এর একটি খসড়া তৈরি করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা, নির্বাচন পদ্ধতি, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, পুলিশ এবং দুর্নীতিদমন প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামোগত সংস্কারের ব্যাপারে সুস্পষ্ট প্রস্তাবনা এসেছে।
সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়ায় ভবিষ্যৎ আইন প্রণয়ন, কার্যকর পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা এবং ফলোআপ রিপোর্ট প্রণয়নের রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, পরবর্তী নির্বাচিত জাতীয় সংসদের প্রথম দুই বছরের মধ্যেই সব সংস্কার কার্যকর করতে হবে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “সনদের ভাষা ও প্রেক্ষাপট রাজনৈতিক দলগুলো পর্যালোচনার সুযোগ পাচ্ছে। যেসব বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরি হবে, তা চূড়ান্ত সংলাপে যুক্ত হবে এবং সনদের চূড়ান্ত রূপ পাবে।”
সনদের খসড়ায় একটি বাধ্যতামূলক রোডম্যাপ নির্ধারণ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন সুসংহতকরণ এবং দীর্ঘদিন ধরে কর্তৃত্ববাদ ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রীয় কাঠামো পুনর্গঠনের লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে।
ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, স্বাক্ষরকারী রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিশ্রুতি দেবে যে, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে গণআন্দোলনে নিহত হাজারো মানুষের আত্মত্যাগকে সম্মান জানিয়ে তারা এই সনদকে একটি সম্মিলিত নৈতিক দায় হিসেবে গ্রহণ করবে এবং তা পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে।
আরও বলা হয়েছে, স্বাক্ষরকারী দলগুলো সাংবিধানিক কাঠামো, বিচার বিভাগ, নির্বাচন ব্যবস্থা, প্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতিদমন ব্যবস্থায় আইনি ও নীতিগত সংস্কারের মাধ্যমে পুনর্গঠনের অঙ্গীকার থাকবে।
এছাড়া প্রতিটি দল প্রতিশ্রুতি দেবে, নির্বাচিত পরবর্তী সংসদের প্রথম দুই বছরের মধ্যে সনদে উল্লিখিত আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার বাস্তবায়ন করবে এবং গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অখণ্ডতা রক্ষায় বাধ্যতামূলক আইনি গ্যারান্টি দেবে।
সনদে বলা হয়েছে, দলগুলো এতে বর্ণিত আইনি, ঐতিহাসিক ও সাংবিধানিক সুরক্ষাসমূহকে সম্মান ও সংরক্ষণ করবে; ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের আলোকপ্রাপ্তি হিসেবে এটিকে একটি ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের মৌলিক পদক্ষেপ হিসেবে স্বীকৃতি দেবে।
ঘোষণার শেষাংশে ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে নিহত শহীদদের স্মরণ করে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলনের লক্ষ্য বাস্তবায়নে সব পক্ষকে একসাথে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
আন্দোলন থেকে সনদ: ঐতিহাসিক এক উত্তরণ
‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’–এর সূত্রপাত ২০২৪ সালের জুলাই মাসে দেশজুড়ে সংগঠিত ঐতিহাসিক ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়। সে আন্দোলনের কেন্দ্রীয় দাবি ছিল ন্যায়বিচার, সুশাসন ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা। আন্দোলনে প্রাণ হারায় এক হাজারেরও বেশি মানুষ, আহত হন বহু। ঘটনাটি দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক সন্ধিক্ষণ হয়ে ওঠে।
এই পটভূমিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে ২০২৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। এতে দেশের ৩৫টিরও বেশি রাজনৈতিক দল ও জোট অংশ নেয়। ২০টি মূল বিষয়ে আলোচনা চালাতে আয়োজিত হয় ৪৪টি বৈঠক।
এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গঠন করা হয় ছয়টি পৃথক সংস্কার কমিশন—সাংবিধানিক সংস্কার, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার, বিচার বিভাগ সংস্কার, প্রশাসনিক সংস্কার, পুলিশ সংস্কার এবং দুর্নীতিদমন কমিশন। সংশ্লিষ্ট কমিশনসমূহ তাদের সুপারিশ ২০২৫ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে সরকারের কাছে জমা দেয়। এরপর ঐকমত্য কমিশন এসব সুপারিশ একত্র করে দুই ধাপে রাজনৈতিক সংলাপের মধ্য দিয়ে একটি খসড়া প্রস্তুত করে।
এই খসড়া এখন চূড়ান্ত সনদের দিকে এগোচ্ছে। সনদ শুধু একটি সংস্কার নথি নয়, বরং একটি আন্দোলনের উত্তরাধিকার ও নৈতিক দায়বদ্ধতার দলিল—যা দেশের ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করবে।