২০২৪ সালে ২৩ স্কোর নিয়ে বিশ্বের দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে ১৪তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। বার্লিনভিত্তিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) ২০২৪ এ তথ্য জানানো হয়েছে।
মঙ্গলবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি জানান, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের স্কোর ২০২৩ এর তুলনায় এক পয়েন্ট কমে হয়েছে ২৩। গত ১৩ বছরে এটি সর্বনিম্ন স্কোর।
ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, ‘বাংলাদেশের স্কোর ২০২২ সাল পর্যন্ত ২৫ থেকে ২৮ এর মধ্যে ছিল। কিন্তু ২০২৩ সালে এক পয়েন্ট কমে এক যুগের মধ্যে সর্বনিম্ন ২৪ হয়। এ বছর আরও এক পয়েন্ট কমে ১৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ২৩ স্কোর পেয়েছে। সূচকে অন্তর্ভুক্ত ১৮০টি দেশের মধ্যে কম স্কোর পাওয়া দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৪তম।’
টিআইব নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘এটি প্রমাণ করে, চৌরতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী সরকার মুখে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বললেও, বাস্তবে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছে, লালন করেছে; এমনকি দুর্নীতি সংঘটনে সহায়তা ও অংশগ্রহণ করেছে। এর প্রভাবে যথেচ্ছ লুটপাট, দুর্নীতিবাজদের রাষ্ট্রীয়ভাবে তোষণ, আইনের সঠিক প্রয়োগ না করা এবং সার্বিক কাঠামোগত দুর্বলতায় বাংলাদেশের অবস্থানের ক্রমঅবনতি হয়েছে।’
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০২৪ সালের সূচকে ৯০ স্কোর পেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে ডেনমার্ক; ৮৮ স্কোর নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে ফিনল্যান্ড ও ৮৪ স্কোর পেয়ে তৃতীয় স্থানে সিঙ্গাপুর। আর ৮ স্কোর পেয়ে তালিকার সর্বনিম্নে অবস্থান করছে দক্ষিণ সুদান; ৯ স্কোর পেয়ে নিম্নক্রম অনুযায়ী দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সোমালিয়া এবং ১০ স্কোর পেয়ে তৃতীয় সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে ভেনেজুয়েলা।
সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, সিপিআইয়ে অন্তর্ভুক্ত ১৮০টি দেশের মধ্যে ৫৭ শতাংশ (১০১টি) দেশ বৈশ্বিক গড় ৪৩ এর কম স্কোর পেয়েছে এবং ৬৮ শতাংশ (১২২টি) দেশের স্কোর ৫০ এর নিচে। এবছর সূচকে অন্তর্ভুক্ত এক-চতুর্থাংশ (৪৭টি) দেশ ২০১২ সাল থেকে গত ১৩ বছরের মধ্যে তাদের সর্বনিম্ন স্কোর পেয়েছে।
ড. ইফতেখার বলেন, ‘বাংলাদেশে দুর্নীতির মাত্রা অতি উদ্বেগজনক। দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তানের পরই বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বনিম্ন স্কোর।
সিপিআই অনুযায়ী দেখা যায়, ২৪টি পূর্ণ গণতান্ত্রিক, ৫০টি ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক, ৩৬টি হাইব্রিড গণতান্ত্রিক ও ৫৯টি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের গড় স্কোর যথাক্রমে ৭৩, ৪৭, ৩৭ ও ২৯; অন্যদিকে বাংলাদেশের স্কোর ২৩, যা বৈশ্বিক গড়ের চেয়েও ২০ পয়েন্ট কম।’
স্কোর বিবেচনায় গতবারের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্লেষণে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, ‘নাগরিক স্বাধীনতা ও মানবউন্নয়ন সূচকে সর্বনিম্ন অবস্থানে থাকা দেশের চেয়েও আমাদের স্কোর কম। এমনকি সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত অঞ্চল, সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলোর চেয়েও বাংলাদেশে অর্জিত স্কোর ১০ পয়েন্ট কম।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশ থেকে পাচার করা অর্থ এমন সব দেশে যাচ্ছে, যারা সূচক অনুযায়ী ভালো অবস্থানে আছে। দেশে ঘটে যাওয়া দুর্নীতির দায় আমাদের, অর্থপাচার রোধে ব্যর্থতার দায়ও আমাদের। কিন্তু সার্বিকভাবে সব দায় শুধুই বাংলাদেশের— বাস্তব চিত্র এমন নয়। সূচকে ওপরের দিকে থাকা দেশগুলোতে দৈনন্দিন জীবনে দুর্নীতির সুযোগ কম হতে পারে, কিন্তু তাদের আইন প্রয়োগ ও চর্চার ক্ষেত্রে এত ফাঁকফোকর রয়েছে, যে সেখানে যথেচ্ছভাবে পাচার করা অর্থ লগ্নি করা সম্ভব। ফলে বাস্তবক্ষেত্রে অর্থপাচারের ফলে লাভবান হিসেবে সেসব দেশ আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি বিকাশে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে।’
উপস্থাপিত সূচকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনকাল পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণের সুযোগ নেই উল্লেখ করে ড. ইফতেখার বলেন, ‘কর্তৃত্ববাদের পতন হলেও, ওই সময় পর্যন্ত (সেপ্টেম্বর ২০২৪) দলবাজি, দখলদারি, চাঁদাবাজি ভিন্ন নামে ভিন্ন পরিচয়ে অব্যাহত ছিল। তাই সামান্য হলেও কর্তৃত্ববাদ পতন পরবর্তী সময়ের পরিস্থিতির প্রতিফলন এখানে রয়েছে। দুর্নীতি প্রতিহত করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাসমূহের মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেষ্টা করছে অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার। কিন্তু তা অব্যাহত থাকবে কিনা তা নির্ভর করছে মূলত সংস্থাটির সক্ষমতার ওপর।’
দুদক সংস্কার কমিশনের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের স্কোর পরে বাড়তে পারে বলে জানানো হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার সহযোগিতা জরুরি বলেও মন্তব্য করে সংস্থাটি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘বাজেটে কালো টাকা সাদা করার বিধানের মাধ্যমে পতিত সরকার দুর্নীতি করতে উৎসাহ দিয়েছিল। দুর্নীতিকে সরকারিভাবে যেমন সুরক্ষা দেওয়া হয়েছিল, তেমনি সামাজিকভাবেও একে স্বাভাবিকতায় পরিণত করা হয়েছিল। এই সংস্কৃতিকে সর্বস্তরে পরিহার করতে হবে। আশঙ্কার বিষয় হলো কর্তৃত্ববাদের পতন হলেও অনেকক্ষেত্রেই কর্তৃত্ববাদী চর্চার পরিবর্তন হয়নি। তবে আমরা আশাবাদী আমাদের তরুণ প্রজন্ম দুর্নীতির সংস্কৃতি নির্মূলের যে সুযোগ করে দিয়েছে, তা অবলম্বন করেই এ অবস্থা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটবে।’
২০২৪ সালের সিপিআই অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র ভুটানের স্কোর ২০২৩ এর তুলনায় ৪ পয়েন্ট উন্নতি হয়েছে। অবশিষ্ট ৭টি দেশের স্কোরই ১ থেকে ৩ পয়েন্ট অবনমন হয়েছে। এর মধ্যে আফগানিস্তানের সর্বোচ্চ ৩ পয়েন্ট, পাকিস্তান ও শ্রীলংকার ২ পয়েন্ট এবং বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও মালদ্বীপের স্কোর ১ পয়েন্ট করে অবনতি হয়েছে। ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী এ বছর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শুধু ভুটান ও নেপালের অবস্থানের যথাক্রমে ৮ ধাপ ও ১ ধাপ উন্নতি হয়েছে। এছাড়া শ্রীলংকার ৬ ধাপ, আফগানিস্তান, ভারত ও মালদ্বীপের ৩ ধাপ এবং বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অবস্থানের ২ ধাপ অবনমন হয়েছে। উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র ভুটান ছাড়া বাকি সাতটি দেশই সূচকের গড় স্কোর ৪৩—এর কম পয়েন্ট পেয়েছে।
সিপিআই অনুযায়ী, দুর্নীতির ধারণার মাত্রাকে ০-১০০ এর স্কেলে নির্ধারণ করা হয়। “০” স্কোরকে দুর্নীতির কারণে সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত এবং “১০০” স্কোরকে দুর্নীতির কারণে সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত বা সর্বাধিক সুশাসিত বলে ধারণা করা হয়। সূচকে অন্তর্ভুক্ত কোনো দেশই এখন পর্যন্ত শতভাগ স্কোর পায়নি। অর্থাৎ, দুর্নীতির ব্যাপকতা সর্বনিম্ন— এমন দেশগুলোতে কম মাত্রায় হলেও দুর্নীতি বিরাজ করে। সিপিআই ২০২৪ এর তথ্যসূত্র হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জন্য সর্বমোট ১৩টি জরিপ ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গতবারের মতো ৮টি জরিপই ব্যবহৃত হয়েছে। ২০২৪ সালের সিপিআই-এ ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ভঙ্গুর এই কাঠামো ঠিক করে দুর্নীতির রাশ টানা এবং দুর্নীতিবাজদের কঠোর বিচারের জন্য টিআইবি ছয় দফা সুপারিশও করেছে।