১৫ শতাংশ শুল্কে মিটল যুক্তরাষ্ট্র-ইইউ বাণিজ্য উত্তেজনা

0

মাসব্যাপী আলোচনা ও টানাপোড়েন পর অবশেষে কাঠামোগত বাণিজ্য চুক্তিতে পৌঁছেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। রবিবারের এই চুক্তি অনুযায়ী ইইউ থেকে পণ্য আমদানির ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে ইইউয়ের ওপর ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছিল দেশটি।

- Advertisement -

- Advertisement -

এই চুক্তির ফলে বিশ্বের মোট বাণিজ্যের এক-তৃতীয়াংশে অংশগ্রহণকারী এই দুই মিত্র বড় ধরনের বাণিজ্যযুদ্ধ এড়াতে সক্ষম হলো।

বার্তাসংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্কটল্যান্ডের পশ্চিমাঞ্চলে ট্রাম্পের বিলাসবহুল গলফ কোর্সে ঘন্টাখানেকের এক বৈঠকের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেয়েন এই চুক্তি ঘোষণা করেন। মাসব্যাপী আলোচনার পর অবশেষে এই চুক্তিতে পৌঁছানো গেল।

ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, “আমার মতে, এটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় চুক্তি।”

তিনি জানান, ইইউ প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ করবে এবং মার্কিন জ্বালানি ও সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় ব্যাপকভাবে বাড়াবে।

ট্রাম্প আরও বলেন, গত সপ্তাহে জাপানের সঙ্গে সই হওয়া ৫৫০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তিকে ছাড়িয়ে এটি ট্রান্স-আটলান্টিক সম্পর্ক আরও জোরালো করবে। ট্রাম্প দাবি করেন, এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করা হচ্ছিল।

ভন ডার লেয়েন ট্রাম্পকে ‘কঠিন দর কষাকষিকারক’ বলে উল্লেখ করে বলেন, ১৫ শতাংশ শুল্ক ‘সার্বজনীনভাবে’ প্রযোজ্য হচ্ছে। পরে সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা যা পেরেছি, সেটাই পেয়েছি।”

তিনি আরও বলেন, “বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে এখন একটি বাণিজ্য চুক্তি হয়েছে। এটি স্থিতিশীলতা ও পূর্বানুমেয়তা আনবে।”

এই চুক্তিটি জাপানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আগের কাঠামোগত চুক্তির সঙ্গে অনেকটা মিল রয়েছে। তবে এখনও কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি, যেমন—মদ জাতীয় পণ্যের ওপর শুল্ক কী হবে।

ট্রাম্পের ভাষ্য অনুযায়ী, চুক্তির আওতায় আগামী কয়েক বছরে ইইউ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৭৫০ বিলিয়ন ডলারের জ্বালানি এবং ‘শত শত বিলিয়ন ডলারের’ অস্ত্র ক্রয় করবে। এতে এয়ারবাস, মার্সিডিজ বেঞ্জ, নোভো নরডিস্কসহ বহু ইউরোপীয় কোম্পানির জন্য সুখবর আসবে, যদি বিস্তারিত শর্ত বজায় থাকে।

জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ ম্যার্জ এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, এতে একটি সম্ভাব্য বাণিজ্য সংঘাত এড়ানো গেছে, যা জার্মানির রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতি ও গাড়ি শিল্পের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতো। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে ২৭ দশমিক পাঁচ শতাংশ শুল্ক রয়েছে, যা ভক্সওয়াগেন, মার্সিডিজ ও বিএমডব্লিউয়ের ওপর বড় আঘাত।

তবুও, ইউরোপে অনেকেই ১৫ শতাংশ শুল্ককে এখনো বেশি মনে করছেন, কারণ ইউরোপ শুরুতে একটি শূন্য-শুল্ক চুক্তির আশা করেছিল।

ইইউ পার্লামেন্টের বাণিজ্য কমিটির প্রধান বার্ন্ড লাঙ্গে বলেন, শুল্কের হার ভারসাম্যপূর্ণ নয়, আর যুক্তরাষ্ট্রে যে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তা ইউরোপের নিজস্ব খরচেই আসবে।

একজন সিনিয়র মার্কিন কর্মকর্তা জানান, ইউরোপীয় দেশগুলো যদি বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি পূরণ না করে, তাহলে ট্রাম্প ভবিষ্যতে শুল্কের হার বাড়ানোর ক্ষমতা রাখেন।

চুক্তি ঘোষণার এক ঘণ্টার মধ্যে ইউরো ডলারের বিপরীতে শূন্য দশমিক দুই শতাংশ বেড়েছে, একইভাবে পাউন্ড ও ইয়েনের বিপরীতেও।

টেনিওর গবেষণা পরিচালক কার্সটেন নিকেল বলেন, এটি একটি ‘উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক সমঝোতা’, যা একটি পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্য চুক্তির বিকল্প হতে পারে না। এর ফলে, ভবিষ্যতে বিভিন্ন ব্যাখ্যার ঝুঁকি থেকেই যায়—যেমনটা জাপান-যুক্তরাষ্ট্র চুক্তির পর দেখা গেছে।

শুল্ক বেশিরভাগ পণ্যের ওপর প্রযোজ্য হবে, যার মধ্যে রয়েছে সেমিকন্ডাক্টর ও ফার্মাসিউটিক্যালস। তবে কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক বজায় রাখবে।

ভন ডার লেয়েন বলেন, এটি কোটার মাধ্যমে প্রতিস্থাপনের বিষয়ে আলোচনা চলছে। এক মার্কিন কর্মকর্তা জানান, ইইউ নেতারা এ নিয়ে আলাপ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

ভন ডার লেয়েন বলেন, উভয় পক্ষই বিমানের যন্ত্রাংশ, কিছু রাসায়নিক, জেনেরিক ওষুধ, সেমিকন্ডাক্টর সরঞ্জাম, কৃষিপণ্য, প্রাকৃতিক সম্পদ ও গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামালের ওপর শুল্ক আরোপ করবে না।

তিনি বলেন, “আমরা আরও পণ্যকে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে কাজ করব।” এখনও মদজাত পণ্য নিয়ে আলোচনা চলছে।

এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, বাণিজ্যিক বিমানের ওপর শুল্ক এখনও শূন্য থাকবে, তবে পর্যালোচনা শেষে দুই পক্ষ একসঙ্গে সিদ্ধান্ত নেবে। ১৫ শতাংশের কম শুল্কে একমত হওয়ার ‘ভালো সম্ভাবনা’ রয়েছে, যদিও নির্দিষ্ট সময়সূচি দেওয়া হয়নি।

এই চুক্তিকে ট্রাম্প প্রশাসন তাদের সাফল্য হিসেবে তুলে ধরবে, যারা বৈশ্বিক অর্থনীতি পুনর্বিন্যাস করতে চায় এবং বহু পুরোনো বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে চায়। তারা ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্য, জাপান, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামের সঙ্গে অনুরূপ কাঠামো চুক্তি করেছে, যদিও ঘোষিত ‘৯০ দিনে ৯০ চুক্তি’ লক্ষ্য এখনও পূরণ হয়নি।

মার্কিন কর্মকর্তারা বলেন, ইইউ স্বীকার করেছে তারা গাড়ি ও কিছু কৃষিপণ্যে অশুল্ক বাধা কমাবে। তবে ইইউ কর্মকর্তারা জানান, এসব মানদণ্ড এখনও আলোচনার মধ্যে আছে।

এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, “তাদের অর্থনীতি ২০ ট্রিলিয়ন ডলারের… জাপানের চেয়ে পাঁচগুণ বড়। তাই তাদের বাজার খুলে যাওয়ার সুযোগ আমাদের কৃষক, জেলে, গবাদিপশু পালক ও শিল্প পণ্যের জন্য বিশাল।”

ট্রাম্প বহুবার ইইউ-এর সমালোচনা করেছেন, বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্রকে ঠকাতেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন তৈরি হয়েছে।” তিনি বহু বছর ধরেই ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে ক্ষুব্ধ। ২০২৪ সালে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৩৫ বিলিয়ন ডলার।

ইইউ বলছে, সেবামূলক খাতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বৃত্ত এই ঘাটতির ভারসাম্য আনে।

ট্রাম্পের ভাষ্য, তার শুল্কনীতি যুক্তরাষ্ট্রে ‘শত শত বিলিয়ন ডলার’ রাজস্ব আনছে, যদিও অর্থনীতিবিদেরা এতে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি নিয়ে সতর্ক করেছেন।

গত ১২ জুলাই ট্রাম্প হুমকি দেন, যদি সমঝোতা না হয়, তাহলে ১ আগস্ট থেকে ইইউ পণ্যে ৩০ শতাংশ শুল্ক বসানো হবে। তখন ইইউ ৯৩ বিলিয়ন ইউরোর পণ্যে পাল্টা শুল্কের প্রস্তুতি নেয়।

You might also like