কাশ্মীর হামলার পর যুদ্ধের ঝুঁকিতে ভারত-পাকিস্তান: বিবিসি

12

কাশ্মীরের পাহালগামে সন্ত্রাসী হামলার পর যুদ্ধের ঝুঁকিতে পড়েছে পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তান। তবে এটি বড় আকারের যুদ্ধে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা কম। বৃহস্পতিবার এমনটাই দাবি করা হয়েছে যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে।

- Advertisement -

- Advertisement -

এতে বলা হয়েছে, পাহালগামে মঙ্গলবারের রক্তাক্ত ঘটনায় অন্তত ২৬ জন পর্যটক গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। এটি ২০১৯ সালের পর কাশ্মীরে সবচেয়ে প্রাণঘাতী জঙ্গি হামলা।

নিহতরা কেউ সেনাসদস্য বা সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন না, তারা ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন ভারতের অন্যতম সুন্দর উপত্যকায়। এ কারণে এই হামলা শুধু নৃশংস নয়, প্রতীকীও। এটি কেবল প্রাণহানি নয়, বরং কাশ্মীরের মতো বিরোধপূর্ণ অঞ্চলে ভারত যে স্বাভাবিক পরিস্থিতি দেখানোর চেষ্টা করছে, তার ওপর সরাসরি আঘাত।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই হামলায় ভারতের প্রতিক্রিয়া নির্ধারিত হবে আগের নজির ও চাপ এই দুইয়ের ভিত্তিতে।

প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায়, দিল্লি দ্রুত কিছু জবাবমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা প্রধান সীমান্তপথ বন্ধ করেছে, একটি গুরুত্বপূর্ণ পানি বণ্টন চুক্তি স্থগিত করেছে এবং কূটনীতিকদের বহিষ্কার করেছে।

এর চেয়েও বড় বিষয় হলো, ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ‘জোরালো জবাব’ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি শুধু হামলাকারীদের নয়, ভারতের মাটিতে ‘এই দুষ্কৃতির’ পেছনের পরিকল্পনাকারীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন।

বিশ্লেষকদের মতে, এখন প্রশ্ন হলো শুধু কবে এবং কীভাবে সামরিক জবাব আসবে এবং তার মূল্য কত হতে পারে।

সামরিক ইতিহাসবিদ শ্রীনাথ রাঘবন বিবিসিকে বলেন, “আমরা সম্ভবত একটি শক্ত প্রতিক্রিয়া দেখতে পাব—যা দেশের ভেতরে এবং পাকিস্তানে একটি বার্তা পাঠাবে। ২০১৬ থেকে, বিশেষ করে ২০১৯ সালের পর, ভারতের প্রতিশোধের মাত্রা নির্ধারিত হয়েছে সীমান্ত পেরিয়ে অভিযান বা বিমান হামলায়।”

তিনি আরও বলেন, “সরকারের পক্ষে এখন এই সীমার নিচে প্রতিক্রিয়া দেওয়া কঠিন। পাকিস্তানও আগের মতো প্রতিক্রিয়া দিতে পারে। ঝুঁকি হলো—উভয় পক্ষের ভুল হিসাব।”

রাঘবন ২০১৬ এবং ২০১৯ সালের ভারতের দুটি বড় প্রতিশোধমূলক অভিযানের কথা উল্লেখ করেন।

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে উরিতে ১৯ জন ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার পর, ভারত নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালায়। তারা দাবি করে, জঙ্গিদের ঘাঁটিতে আঘাত হানা হয়েছিল।

২০১৯ সালে পুলওয়ামায় আত্মঘাতী হামলায় কমপক্ষে ৪০ জন আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য নিহত হওয়ার পর, ভারত পাকিস্তানের বালাকোট এলাকায় একটি কথিত জঙ্গি ক্যাম্পে বিমান হামলা চালায়। ১৯৭১ সালের পর পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারতের এটি প্রথম অভিযান। পাকিস্তান পাল্টা বিমান হামলা চালায়, যার ফলে দুই দেশের বিমান বাহিনীর মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় এবং একজন ভারতীয় পাইলট স্বল্প সময়ের জন্য বন্দি হন। দুই দেশ শক্তির প্রদর্শন করলেও পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ এড়ায়।

এর দুই বছর পর, ২০২১ সালে, দুই দেশ নিয়ন্ত্রণরেখায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়, যা এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ সময়ই কার্যকর রয়েছে। যদিও ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে মাঝে মাঝে জঙ্গি হামলা হয়।

পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান মনে করেন, সাম্প্রতিক হামলায় ভারতীয় বেসামরিকদের লক্ষ্য করে উচ্চমাত্রায় প্রাণহানি হয়েছে। এ কারণে ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা জোরালো হয়েছে। যদি দিল্লি কোনোভাবে পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত করে বা এমন ধারণা করে।

তিনি বিবিসিকে বলেন, “ভারতের জন্য এমন প্রতিক্রিয়ার প্রধান সুবিধা হবে রাজনৈতিক, কারণ জনগণের কাছ থেকে জোরালো চাপ থাকবে শক্তভাবে জবাব দেওয়ার জন্য।”

“আরেকটি সুবিধা হলো—যদি প্রতিশোধমূলক হামলায় সন্ত্রাসী ঘাঁটি ধ্বংস করা যায়, তাহলে ভারতের প্রতি হুমকি কমে যাবে এবং প্রতিরোধের সক্ষমতা ফিরে আসবে। তবে বিপদ হলো—এই ধরনের প্রতিশোধ একটি বড় ধরনের সংকট এবং সংঘাত ডেকে আনতে পারে।”

ভারতের সামনে কী কী বিকল্প আছে?

আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অ্যাট অ্যালবানি-এর ক্রিস্টোফার ক্ল্যারি বলেন, “গোপন অভিযান চালালে দায় স্বীকার না করেও প্রতিক্রিয়া জানানো যায়, কিন্তু তাতে দৃশ্যমানভাবে প্রতিরোধ দেখানোর রাজনৈতিক চাহিদা পূরণ নাও হতে পারে।”

তিনি বলেন, এতে ভারতের সামনে দুটি পথ খোলা থাকে।

প্রথমত, ২০২১ সালের নিয়ন্ত্রণরেখায় যুদ্ধবিরতি এখন আর আগের মতো শক্ত নেই। তাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সীমান্তে গুলি চালানোর অনুমতি দিতে পারেন।

দ্বিতীয়ত, ২০১৯ সালের মতো আবার বিমান হামলা কিংবা প্রচলিত ক্রুজ মিসাইল হামলার পথও খোলা আছে—যার প্রত্যেকটিতেই প্রতিশোধমূলক প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি রয়েছে, যেমনটা আগের বিমান লড়াইয়ে দেখা গেছে।

“কোনো পথই ঝুঁকিমুক্ত নয়। যুক্তরাষ্ট্র এখন নানা দিক নিয়ে ব্যস্ত। তারা হয়তো এই সংকট মোকাবিলায় সহায়তা করতে পারবে না বা আগ্রহী নাও হতে পারে,” বলেন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি বিষয়ক গবেষক ক্ল্যারি।

ভারত-পাকিস্তান সংকটে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো—উভয় দেশই পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত। এই বাস্তবতা প্রতিটি সিদ্ধান্তে ছায়া ফেলে। শুধু সামরিক কৌশল নয়, রাজনৈতিক হিসাবকেও প্রভাবিত করে।

রাঘবন বলেন, “পারমাণবিক অস্ত্র একদিকে ঝুঁকি, অন্যদিকে এটি একটি সীমাবদ্ধতা—এটি উভয় পক্ষের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের সতর্ক করে তোলে। যেকোনো প্রতিক্রিয়া ‘নির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক ও সীমিত’ হিসেবে উপস্থাপন করা হবে। পাকিস্তানও পাল্টা জবাব দিতে পারে, এরপর উত্তেজনা কমানোর পথ খুঁজবে।”

“আমরা এমন প্যাটার্ন অন্য সংঘাতে দেখেছি। যেমন ইসরায়েল-ইরান সংকটে। যেখানে লক্ষ্যবস্তুতে হামলা হয়, এরপর উত্তেজনা কমাতে চেষ্টাও চলে। তবে ঝুঁকি হলো ঘটনা সব সময় পরিকল্পনামতো নাও চলতে পারে।”

মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, পুলওয়ামা সংকট থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো—“প্রতিটি দেশই সীমিত পাল্টা প্রতিক্রিয়ার মধ্যে আরামবোধ করে।”

“ভারতকে প্রতিশোধ নেওয়ার রাজনৈতিক ও কৌশলগত সুবিধা এবং তার বিপরীতে একটি গুরুতর সংকট বা সংঘাতের ঝুঁকি—এই দুইয়ের ভারসাম্য বিবেচনা করতে হবে।”

যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হুসেইন হক্কানি মনে করেন, এইবার উত্তেজনা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভারতের পক্ষে ২০১৬ সালের মতো সীমিত ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালানোর কথা ভাবা স্বাভাবিক।

তিনি বিবিসিকে বলেন, “ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে এমন হামলার সুবিধা হলো—এগুলো সীমিত পরিসরে হয়, ফলে পাকিস্তানের পাল্টা জবাব দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। একই সঙ্গে ভারতের জনগণের কাছে একটি বার্তা দেওয়া যায় যে, সরকার প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।”

“কিন্তু এই ধরনের হামলা পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া ডেকে আনতে পারে, কারণ পাকিস্তান মনে করে, কোনো তদন্ত বা প্রমাণ ছাড়াই দায় চাপানো হচ্ছে, যা একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া মাত্র।”

ভারত যেই পথই বেছে নিক, আর পাকিস্তান যেভাবেই জবাব দিক না কেন—প্রতিটি পদক্ষেপ ঝুঁকিপূর্ণ। উত্তেজনা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে, আর এর সঙ্গে সঙ্গে কাশ্মীরে যে নাজুক শান্তি আছে, তা আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে।

একই সময়ে, ভারতকে এই সন্ত্রাসী হামলার পেছনের নিরাপত্তাগত ব্যর্থতার দিকটিও খতিয়ে দেখতে হবে।

ইতিহাসবিদ শ্রীনাথ রাঘবন বলেন, “এই হামলাটি যখন ঘটেছে, তখন কাশ্মীরে পর্যটন মৌসুমের চূড়ান্ত সময় চলছে। এটি একটি গুরুতর নিরাপত্তা ব্যর্থতা নির্দেশ করে। বিশেষ করে যখন এটি এমন একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে হয়েছে, যেখানে কেন্দ্র সরকারই আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করে।”

You might also like